মুস্তফা সারোয়ার ফারকীর “ডুব”: একটি ধারণাগত তাত্ত্বিক অনু-বিশ্লেষণ (Conceptual micro Analysis)

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শুক্র, ১৬/০২/২০১৮ - ৭:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা বই পড়তে পড়তে চিন্তা করতে পারি। কারণ কয়েকটি বর্ণের মধ্যে দিয়ে কল্পনায় ধ্বনি এবং ইমেজ বা চিত্রকল্প তৈরি করতে করতে আমরা বইকে পড়ি। অক্ষরের মধ্যে ছবি ভেসে ওঠে। শব্দরা জেগে ওঠে। তাই বই পড়া মানে মাথার মধ্যে সিনেমা দেখা। নিজের তৈরি সিনেমা।
কিন্তু সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা চিন্তা করতে পারি না। মাথার মধ্যে সিনেমাটা বানাতে পারি না। কারণটা সহজ। আমাদের চোখের সামনেই তখন সিনেমা চলছে। আমরা সেই সিনেমায় ডুবে আছি। আমরা চোখের পলক ফেলছি না। কানতো সদা জাগ্রত। চোখ তবু বন্ধ করা যায়, দৃশ্যকে আমরা চোখ বন্ধ করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারি। কান, তার ওপর আমাদের হাত খুব কম। শব্দ ও শুনবেই। তাই সিনেমা দেখার সময় ফলে মাথায় চিন্তার জন্য উপায় থাকে না। চিন্তা করতে গেলেই সিনেমা মিস হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে গেলেই সিনেমার পর্দা লুকিয়ে যাচ্ছে। সিনেমা এভাবেই আমাদের ‘সিনেমার বর্তমানে’ থাকতে বাধ্য করছে। সবটুকু সংবেদনকে ব্যস্ত রাখছে। এই সংবেদন আমাদের মধ্যে ‘দেখা’ তৈরি করছে। লোকায়ত দার্শনিকদের একটি ধারাভাষ্যে ‘দেখা’ হলো ঘণিভূত চিন্তা, Concentrated Thoughts- যার উৎস অভিজ্ঞতা থেকে। যা অনুভবে গিয়ে অনুরনন তোলে।
এজন্যই সিনেমার কাছে নিজেকে নিবেদন করতে এত ভালো লাগে আমাদের। অভিজ্ঞতার মতোন।

মুস্তফা সারোয়ার ফারুকী’র ডুব এই সিনেমার ভাবনাটাই এই প্রচলিত কাঠামোকে একটু উল্টে দিয়ে ভাবা। বই পড়তে পড়তে যেমন কল্পনা, ভাবনা, স্মৃতি দিয়ে আমরা সিনেমা দেখি সিনেমা দেখতে দেখতেও আমরা ওরকম নিনেমা দেখতে পারি কি না। যেই সিনেমাটা ঠিক পর্দায় নেই। আছে মনের মধ্যে। যা আমরা তৈরি করতে করতে দেখছি। সিনেমার প্রচলিত ভাষার দিক থেকে এই সিনেমার ভাষা ছিলো পুরোটাই নতুন।
পুরো সিনেমাটি দেখতে গিয়ে আপনি প্রায়ই নানান কথা ভাববেন।
কী ভাববেন, এটা আপনার।
এই ভাবনাটা তৈরি করার জন্য মুস্তফা সারোয়ার ফারুকী অসংখ্য জানালা তৈরি করেছেন।
গল্প বাছাই থেকে শুরু করে নির্মানের নানা অনুসঙ্গ ঘুরে তিনি অনেকগুলো শূন্যতা তৈরি করেছেন। যেই শূন্যতাগুলো আমরা আমাদের ভাবনা কথা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারি।
যেমন, কাহিনীর অস্পষ্টতা। আমরা অনেকেই ভাবি, গল্পটি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। এই ভাবনা মাথায় নিয়ে ছবি দেখতে গিয়ে আমরা অনেক কিছু ভেবে ফেলি। মিল, অমিল। ছবির ভাষায় এই দোলাচলটি অপূর্ব সুষমার জন্ম দিয়েছে। নিজের অজান্তেই আমরা নিজের নিজের ভাবনায় ডুবে গেছি।
কাঠামোগত জায়গা থেকে এই ভাবনায় ডুবে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার জন্য নৈঃশব্দতাকে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায়ই ছবিতে কোন কিছু ঘটে না, এমন দীর্ঘ সময় আসে। কোন শব্দ নেই। চোখের সামনে যে ফ্রেম তা সুন্দর, কিন্তু সে কিছুই জানাচ্ছে না। নিসর্গের মতো পেছনে (Background) এ চলে যাচ্ছে frame গুলো। মুস্তফা সারোয়ার ফারুকী এই জায়গাটিতে নিঃশব্দে সবচেয়ে তোলপাড় করা ঘটণাটি ঘটাতে পেরেছেন, তিনি চরিত্রগুলোকে Background এ পাঠিয়ে দিতে পেরেছেন। খুব ক্লোজ দৃশ্য, কোন চরিত্রের- সেও পর্দা থেকে হারিয়ে টুপ করে। আমাদের ভাবনা এসে পর্দার ছবিটা মুছে ফেলে। আমরা হারিয়ে যাই। নতুন সিনেমার জন্ম হয় আমাদের মধ্যে। আমরা আসলে যে সিনেমাটা দেখে বের হয়ে আসি, সেই সিনেমাটা পর্দায় ছিল না। সিনেমা দেখতে দেখতে আমাদের ভেতরে ডুব দিয়ে আমরা ছবিটাকে দেখেছি। যদিও কী ছবি দেখেছি তা আমরা আর পরে মনে করতে পারবো না। একটি সুন্দর গান শুনলে ঠিক তখন কেমন লেখেছিল পরে যেমন তা আর পরে ফিরিয়ে আনা যায় না তেমন। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা বলতেই পারবো না, ছবিটা আসলে কী দেখালো।
সম্পাদনা, শব্দ, ছবির যে কালার টোন সবকিছুকে এই ভাষা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। চোখ বা নজর কাড়ার চেয়ে ভুলিয়ে দেয়ার একটা লক্ষ্য ছিল। সবকিছু মিলিয়ে ‘ডুব’ সিনেমার আঙ্গিকগত দিক থেকে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। নতুন ভাষা তৈরি সহজ নয়। এই দেশে ‘নতুন’ আরও কঠিন। আমরা হৃদয় দিয়ে দেখতে ভালবাসি। চিন্তা আমাদের দেশে ‘ভাব এর বস্তু’। এমন একটা দেশে, নতুন একটা চিন্তাকে রূপায়ন করা কঠিন। ‘ডুব’ নতুন চিন্তার চর্চায় আমাদের দেশ থেকে Master Work হিসেবে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধরা যাক, একজন দর্শক যিনি বাংলা ভাষা জানেন না; বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু জানেনা; হুমায়ুন আহমেদ দূরে থাক রবীন্দ্রনাথের নামও শোনেননি; বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কেও অজ্ঞ। এই দর্শক একদিন ইন্টারনেটে বা নেটফ্লিক্সে বা কোন চলচ্চিত্র উৎসবে 'ডুব' মুভিটা দেখে ফেললেন, বাংলা ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় দেয়া সাবটাইটেল পড়ে পড়ে। আমরা নিজেরা এমন বহু মুভি দেখেছি, সুতরাং ব্যাপারটা মোটেও অবাস্তবোচিত নয়। তো এই দর্শক কি 'ডুব' দেখে কিছু বুঝতে পারবেন? আপনার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এখানে সৃষ্ট 'শূন্যতা'গুলো চিহ্নিত করতে পারবেন? আপনার hypothesis অনুযায়ী ঐ দর্শক কি 'ডুব'-এর মধ্যকার শূন্যতাগুলো নিজের মতো করে ভরিয়ে তুলতে পারবেন?

সবকিছু মিলিয়ে ‘ডুব’ সিনেমার আঙ্গিকগত দিক থেকে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা

- দয়া করে এই decisive statement-টার পক্ষে যুক্তি দিন। যতটুকু বলেছেন তাতে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পেছনের যুক্তি স্পষ্ট নয়।

আমরা হৃদয় দিয়ে দেখতে ভালবাসি

- এই অনুসিদ্ধান্তটি সঠিক হলে আপনার hypothesis অনুযায়ী এদেশের দর্শকরা 'ডুব'-এর মধ্যকার শূন্যতাগুলো হৃদয় দিয়ে দেখে নিজের মতো করে ভরিয়ে তুলতে ভালোবাসবেন - তাই না!

‘ডুব’ নতুন চিন্তার চর্চায় আমাদের দেশ থেকে Master Work হিসেবে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে

- এখানে নতুন চিন্তার বিষয়টা কী? খোদ হুমায়ুন আহমেদের এমন অনেক উপন্যাস/গল্প আছে যেখানে কাহিনী চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে কোন পরিণতি ছাড়া শেষ করে দেয়া হয়েছে। পাঠক যার যার মতো করে পরিণতি ভেবে নেবেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এমন লেখা আছে যেখানে কোন বাক্য সম্পূর্ণ করা হয়নি। প্রতি পদে পদে পাঠককে নিজের মতো করে বাক্য সম্পূর্ণ করে যেতে হবে। সুতরাং বাংলা সাহিত্যে শূন্যতা রেখে দেয়া নতুন কিছু নয়। জহির রায়হানের 'কখনো আসেনি' বা 'কাঁচের দেয়াল', আলমগীর কবীরের 'সূর্য্যকন্যা'-তেও এমন শূন্যতার দেখা আমরা পেয়েছি যা দর্শকদেরকে নিজেদের মতো করে পূরণ করতে হবে। সুতরাং বাংলা মুভিতেও বিষয়টা নতুন কিছু নয়। 'ডুব' কী বিচারে Master Work হলো সেটা আর স্পষ্ট হলো না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কর্ণজয় এর ছবি

আপনার যুক্তিগুলো আমি অস্বীকার করছি না, বরং এগুলোকে মেনেই আমি আমার অবস্থানটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কথাটি স্ববিরোধী, কিন্তু এর জন্ম একটা দুটো বিপ্রতীপ মনোভঙ্গির মধ্যে, যে দুটো মনোভঙ্গি সারোয়ার ফারুকীর বেলায় আমার মধ্যে কাজ করে। আপনি আমার প্রিয় লেখকদের একজন, যার কাছে নিজেকে বোঝাতে পারার চেষ্টাই আমি শুধু করতে পারি।
আপনি শুরুতে একজন বিদেশী দর্শকের জায়গা থেকে এই চলচ্চিত্রকে বোঝার সম্ভাবনা নিয়ে জিজ্ঞাসা তুলেছেন। আমার বিবেচনায়, সেই সম্ভাবনা খুবই কম। তার বুঝতে পারারই কথা না। এমন কী, আমাদের দেশের যারা হুমায়ুন আহমেদের জীবনের শেষ অংকের গল্প জানেন না তারাও এই ছবিটার ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। এই ছবিটা হচ্ছে একটা গসিপের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। খুব জেনেশুনে। আমার মনে হয়েছে, যদি ঠিক এমন একটা গল্প আন্তর্জাতিক পরিসরে করতে হয় তবে, লেডি ডায়ানার ছায়া থেকে ছবিটা তৈরি করতে হবে। এটা ভাল বা খারাপ সে বিচারে আমি যাচ্ছি না, এই নিয়ে আপনি আমাকে দোষ দিতে পারেন, কিন্তু সত্যি কথাটা হলো আমি নৈতিক বিচারে না গিয়ে এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশি ভেবেছি। নিশ্চয় এটি একটি সীমাবদ্ধতা। কিন্তু দৃষ্টিকোণ মাত্রই একটি সীমাদ্ধতা।
সবকিছু মিলিয়ে ‘ডুব’ সিনেমার আঙ্গিকগত দিক থেকে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা-
এই বক্তব্যে ছোট্ট একটি শব্দের অসম্পূর্ণতা আছে। সেটা আমারই ভুল। শব্দটি হলো- সময়। আমি এই সময়ের বোঝাতে চাইছি। এই সময়ে চলচ্চিত্রের কারিগরী দিকের যতটা উন্নতি দেখি, চিন্তার দিক থেকে দৈন্যভাবটা যেন ততই বেশি চোখে পড়ে। আপনি যে ছবির নামগুলো বললেন, আমি তার সাথে একমত হয়ে আরও একটি ছবির নাম বলতে চাই- সেটি হলো তারেক মাসুদের ‘অন্তর্যাত্রা’। এই ছবিটি আমার বিবেচনায়, সেই সময়ের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ছবি- সবচেয়ে সাহসী ছবি যা কখনওই তার প্রাপ্য স্থানটা পায় নি। এটার কারণ ছিল, তারেক মাসুদ প্রথম ডিজিটাল সিনেমা হিসেবে এর কারিগরী প্রক্ষেপণ থেকে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। কিন্তু এই সিনেমার মধ্যেও শূন্যতা ছিল, যেখানে আমরা কল্পনার ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর অনেকগুলো জায়গা ছিল। ‘সীমানা পেরিয়ে’ সেটিও আমাদের ভাবনার মধ্যে নিক্ষেপ করে। সেখানেও আমরা অনেক নৈঃশব্দতা দেখি, যার মধ্য দিয়ে আমরা ভঅবনার খেলা চালিয়ে যেতে পারি। এদিক থেকে ‘ডুব’ ঐ ছবিগুলোর তুলনায় এই সময়ে এসেও পিছিয়ে আছে।
কিন্তু কে না পিছিয়ে আছে? চলচ্চিত্রে চিন্তার দৈন্যতার কালে এসে, ফারুকীকে আমার মনে হয় হয়- এতটুকু কৃতিত্ব দেয়া উচিৎ, তিনি প্রথাগত সিনেমার বাইরে গিয়ে তারমতো একটা সিনেমার কথা ভাবেন। এই দেশে এটা কঠিন। তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত, স্টাবলিশ- কিন্তু স্টাবলিশমেন্টের পথ ধরে নয়। তিনি তার মতো থেকেই স্টাবলিশমেন্টকে তাকে মানতে বাধ্য করেছেন। গল্পহীনতার মধ্যে গল্প থাকে, সেই গল্পকে বলতে পারার সাহস দেখেছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেখানে আমরা গল্প আছে এমন গল্পকেই বলতে শিখি নি (এখনকার সিনেমার বাস্তবতায়) সেখানে এটা আমার কাছে তার কৃতিত্ত্ব মনে হয়েছে। তার ভাষা নিয়ে আমাদের অনেকের আপত্তি আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে পরিশীলিত ভাষা চর্চার চেষ্টা করি। সারোয়ার ফারুকীর সিনেমায় (আগে নাটক) ভাষার ব্যবহারটা যেভাবে তিনি ঘটিয়েছেন, তা আমাদের ভাষা চর্চায় অনেক ক্ষতি ডেকে নিয়ে এসেছে- এ কথাটা অস্বীকার না করে বিষয়টা একটু অন্যভাবে বলতে চাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, এ সময়ে যে বিচ্ছিন্নতা আমাদের গ্রাস করেছে, তার মধ্য দিয়ে যে আমরা জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি সংশ্লিষ্টতা হারিয়েছি, তার ফলাফল আমরা যে ভাষায় গালি দেই, সে ভাষাতেই প্রেম করি, সে ভাষাতেই শ্রদ্ধা জানাই। অর্থাৎ গুরুত্ব সবকিছুর সমান হয়ে গেছে। আমরা আর আলাদা করতে পারছি না কিছু। সবকিছুই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুত্বহীন পর মুহূর্তেই। এই ভাষাটি তারই একটা প্রকাশ চিহ্ন হয়ে উঠেছে। আর ফারুকী তা বুঝতে পেরে তা তুলে এনেছেন।
সারোয়ার ফারুকীর এই ‘ডুব’ ছবি বানানোর পেছনে যে বিবেচনা কাজ করেছে তা ভাবতে গিয়ে এমন মনে হয়েছে
১. একটা ছবি বানানো যেতে পারে যেখানে মানুষ ছবি দেখতে দেখতে ভাবতে পারবে। যেটা তার কাছে মনে হয়েছে, এর ফলে সিনেমায় একটা নতুন ভাষা তৈরি হবে। আমরা বিভিন্ন সময় তাকে বারবার এই কথাটাটিকে প্রায় চিৎকারের মতো বলতে শুনেছি। এটা একটা নতুন ভাষা। এটা একটা নতুন সিনে ভাষা। সিনে language…
২. মানুষকে নতুন গল্প দিয়ে ভাবনার ভেতরে ফেলবার জটিলতায় তিনি যান নি। যদি যেতেন, তাহলে তাহলে তা আরও কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠতো। এটা না করে, তিনি মানুষের আঁধা জানা একটি বিষয়কে বেছে নিয়েছেন। মানুষ সন্ধ্যা আর ভোরের মতোই- পুরো জানা এবং পুরো অজানার বদলে আধা জানা আধা অজানা, এমন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ে বেশি। ফারুকী এই আধাঁ জানাকে ভাবনা দিয়ে পূর্ণ করার সহজাত প্রবণতাকে ছবি উপভোগের একটা প্রকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এভাবে সিনেমা বিষয়ে আঙ্গিকগতভাবে চিন্তা করাটাই এই বন্ধ্যা সময়ে অনেক মনে হয়েছে। সে কারণে ‘ডুব’কে এই সময়ের আঙ্গিকগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা মনে হয়েছে।
৩. হৃদয় এবং চিন্তা- এই দুটি শব্দের ক্ষেত্রে একটি বড় ফারাক আছে। ফারুকীর এই কাজটিকে তার আগের কাজের তুলনায় অনেক চিন্তাপ্রসূত মনে হয়েছে, অন্তত কাঠামোর দিক থেকে। তিনি সিনেমার হৃদয়কে নিয়ে ভাবেন নি। তিনি ভেবেছেন দর্শকের হৃদয় নিয়ে। আর সিনেমা নিয়ে ভেবেছেন চিন্তা দিয়ে। তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন। তার চেনা এবং ভক্ত দর্শককূলকে দূরে ঠেলে দেয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এটাকে বোকার সাহস বলা যেতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি বোকা নন, বোকা হতে পেরেছিলেন। যেটাও তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। একটা সুন্দর গল্প, সুন্দর চিত্রায়ন, বাস্তবতার নিখূঁত চিত্র বা রোমান্টিতার নাটুকেপণা- এরকম কাঠামোর বাইরে তিনি ছবিটাকে নিয়ে যেতে পেরেছেন এটা আমার মনে হয়েছে। এটাকেই বলছিলাম মাস্টার কাজ। মধ্যবিত্ত নির্মাতার পক্ষে এটি সম্ভব না। সম্ভবত এই বিষয়টা ঠিকমতো বোঝাতে পারছি না।
আমরা হৃদয় দিয়ে দেখতে ভালবাসি
- এই অনুসিদ্ধান্তটি সঠিক হলে আপনার hypothesis অনুযায়ী এদেশের দর্শকরা 'ডুব'-এর মধ্যকার শূন্যতাগুলো হৃদয় দিয়ে দেখে নিজের মতো করে ভরিয়ে তুলতে ভালোবাসবেন - তাই না!
হ্যা এটাই। আমি চিন্তার বলতে যেটি বলতে চেয়েছি সেটা হলো পরিচালকের অবস্থান। সেখানে হৃদয় এর চেয়ে চিন্তা বেশি ক্রীয়ারত।
এটি একটি ছবি যা নিজে চিন্তা হিসেবে থেকে গেছে। হৃদয় হতে পারে নি। এক ধরণের একাডেমিক জায়গা থেকে এই সিনেমার মূল্য একটু এক্সপেরিমেন্টাল। যে যুগে সবাই ঠিক মোড়কের মধ্যে নিশ্চিন্ত হতে চায়, সেখানে ডুব নিশ্চিন্ত হতে চায় নি। এটার গুরুত্ব আমার কাছে এই সময়ে অনেক বড় মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে সিনেমার ইতিহাসে এই ছবি নিয়ে কয়েকটি লাইন থাকবে, কিন্তু হৃদয়ে হয়তো নয়। সেখানে রূপালী সৈকতে, সীমানা পেরিয়ে, অন্তর্যাত্রা খেলা করে যাবে। কিন্তু চলচ্চিত্রের এই দিশাহারা সময়ে ফারুকীর ছবি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সকল সময়েই কেউ না কেউ সময়কে এগিয়ে নিয়ে যায়।

হিমু এর ছবি

যা বুঝলুম:

ফারু গদারের ছালাদিয়া হোটেল

!!!এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে সকল প্রকার পদ পরিবেশন করা হয়!!!
বাসন, লোটা, লবণ, লেবু, মরিচ, শশা, আচার, ভাত ও তরকারি আপন আপন বাসা হইতে লইয়া আসিবেন। বিফলে মূল্য ফেরত দেওয়া হয় না। হাততালিতে বংশের পরিচয়।

কর্ণজয় এর ছবি

ভাই ব্রেদারদের অনেককে দেখেছি এই হোটেলটায়… বেশ চালু

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ফারুকী সাহেব প্রথমেই একটা ফাউল কাজ করেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়ের কাহিনী নিয়ে একটা সিনেমা বানিয়ে বাজীমাৎ করতে চেয়েছেন। মৌলিক কোন কিছু করার মুরোদ না থাকলে তা ছাড়া আর উপায়ই বা কী? কিন্তু সেটা করতে গেলে যেহেতু যথেষ্ট হাউকাউ হবার সম্ভাবনা আছে, তাই পুরা বিষয়টায় কিছুটা টুইস্ট মিশিয়ে দিয়েছেন, যাতে প্রয়োজন মত পিছলা খাওয়া যায়। এটাই হল এই ছবির মহান শূন্যতা আর অস্পষ্টতা। এতেই ডুব দিয়ে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে মহান সব মাষ্টারি কর্মকান্ড! সাধু! সাধু!!

কর্ণজয় এর ছবি

একটু দুষ্টুমী করেছেন, তাতে ভুল নেই। তা উনি দুষ্টুই একটু

ফাহিম এর ছবি

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, লেখক খুবই উচ্চ মার্গের একটি সার্কাজম করেছেন।

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

কর্ণজয় এর ছবি

আমিও তাই ভাবছিলাম। অন্যদের গালি দেয়ার জন্য কি তার প্রশংসা?

সোহেল ইমাম এর ছবি

“হাসবো না কাঁদবো” এইরকম একটা কথা আছে বাংলায়। ভাইয়ের এটা ঠাট্টা না তামাশা এটা বুঝতেই বেলা গেলো। আমি ভাবছিলাম মুড়িঘন্ট নিয়েও কিছু লিখবেন। ডুব ছবিতে মুড়িঘন্টের একটা ভালো তাৎপর্য আছে, সিনেমা নিয়ে দু’টো কঠিন কঠিন কথা জানলে আমি এই নিয়ে লিখতাম। অজ্ঞতার জন্যই মুড়িঘন্টের বাটিটা ধরে আর টানাটানি করলামনা। দেঁতো হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

কর্ণজয় এর ছবি

আসলেই আছে কিন্তু।।। খুব ভাল তাৎপর্য আছে। নামের মাঝেই টের পাওয়া যায়।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

দেখি নাই।

হাসিব এর ছবি
ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সাবেরী বা নীতু'র মতো কেউ একজন যদি এক বাটি মুড়িঘন্ট এনে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতো তাহলে মুভিটা দেখার চেষ্টা করা যেতো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।