সংক্ষেপিত অনুবাদ : বাংলা ভাষা পরিচয় / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : অধ্যায় ১

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: সোম, ০৫/০৬/২০২৩ - ২:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সবচেয়ে অসত্য ভাবনা কী?
‘অবশেষে জানিলাম- মানুষ একা।”
কেন অসত্য?
কারণ, প্রত্যেকটি মানুষ বহু মানুষের হাতে তৈরি।
বহু মানুষের সাথে যুক্ত।
সে একলা একা হতেই পারে না।

বহু যুগের বহু কোটি মানুষের দেহ মন মিলিয়ে মানুষের সত্তা।
সেই বৃহৎ সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক
একজন ব্যক্তি মানুষ যতটুকু দেখতে পারে
সে ততটুকু যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে।
সেই সত্তাকে নাম দেয়া যেতে পারে
মহামানুষ।

এই বৃহৎ সত্তার মধ্যে
ছোট একটা অংশ আছে।
জাতিক সত্তা।
একটা ধারার মতো
ধারাবাহিকভাবে
পরম্পরায় মিলে
বহু কোটি মানুষ
একটা সীমানায় বাঁধা পড়ে।
এদের চেহারার একটা মিল আছে।
মনের গড়নটায় মিল আছে।
মনেরও একটা মিল আছে।
যার জন্য সবাই সবাইকে আত্মীয় ভাবে।
মানুষকে মানুষ করে তোলে
এই জাতিক সত্তা।

সেই জন্য মানুষের নিজেকে আত্মরক্ষার মানে
এই জাতিক সত্তাকে রক্ষা করা।
এই তার বৃহৎ দেহ।
এই তার বৃহৎ আত্মা।
এই বোধ যাদের দূর্বল
সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার শক্তিও তাদের কম।
জাতির নিবিড় সম্মিলিত শক্তি
তাদের রক্ষা করে না।
সে পদে পদে পরাজিত হয়।
কেননা, তারা সম্পূর্ণ মানুষ নয়।

মানুষ সম্মিলিত জীব, সে একলা নয়
তাই শিশুকাল থেকে মানুষের প্রধান শিক্ষা
সবার সাথে সে কীভাবে মিলতে পারবে
সেই শিক্ষা।

এই শিক্ষার বাঁধা অনেক:
প্রতি মুহূর্তে।
কোথায় বাধা?
মানুষের ভেতরের জন্তু ধর্ম
স্বার্থের টানে
আলাদা, স্বতন্ত্র হওয়ার লোভ
সবার সাথে মিলতে বাধা দেয়।
তখন সমষ্টির শিক্ষা, সম্মিলিত মানুষ সত্তা
বলে
‘তোমাকে মানুষ হতে হবে কষ্ট করে।;
জন্তুধর্মের উল্টো পথে গিয়ে।’
এখানেই জাতির ভূমিকা।
তারা পরষ্পরকে চেনে,
নিজের পাশে পরষ্পরকে আশা করে।
মানুষ জন্মায় জন্তু হয়ে;
কিন্তু সবার মধ্যে থেকে
অনেক কষ্ট করে
সে মানুষ হয়ে ওঠে।
এই যে সম্মিলিত মানুষ,
যার দেহটাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘সমাজ’-

সমাজ মনুষত্বের জন্ম দেয়; আবার
তাকেও মানুষেই সৃষ্টি করে চলে
প্রাণ দিয়ে, ত্যাগ দিয়ে, চিন্তা দিয়ে
নতুন নতুন নব নব অভিজ্ঞতা দিয়ে
কালে কালে প্রতি মুহূর্তে
তাকে নতুন রূপে সাজিয়ে।
এটাই সমাজের প্রাণ।

ব্যক্তি মানুষ আর সমাজের মধ্যে
এই অবিশ্রাম
এই দেয়া নেয়া না থাকলে
সমাজও হয়ে উঠতো জড়
মানুষও থেকে যেতো জন্তু।
সমাজ আর সমাজের মধ্যেকার যে ব্যক্তি মানুষ
তাদের মনের ভাবের
তাদের মনের, চিন্তার
আদানপ্রদানের জন্য মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি
তার ভাষা।
ভাষার মধ্য দিয়ে
আমি আমি তুমি তুমি
একসাথে মিলে আমরা হয়ে উঠছি।
এক হয়ে উঠছি।
মানুষ যে মানুষ হলো
এই শক্তি তার ভাষার মধ্যে।

এইজন্য
পবিত্র বাইবেলের শুরু হচ্ছে যে (Genesis 1)
In the beginning was the Word, and the Word was with God, and the Word was God.
শুরুতে বাক্যই ছিল। বাক্য ছিল ঈশ্বরের সাথে। আর বাক্যই ছিল ঈশ্বর।
পবিত্র কোরাণে, আল্লাহ জগৎ- ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেন
একটি শব্দ দিয়ে।
আল্লাহ উচ্চারণ করলেন
‘কুন’- মানে ‘হও
এবং জগৎ ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হলো।
এটা একটা মজার রসায়ন।
আমি ভাষা তৈরি করি
ভাষাও আমাকে তৈরি করে।
এটা দেখা যাচ্ছে,
আমার অস্তিত্ব আমার, ‘ভাষা’র মধ্যে।

[অনেকদিন ধরে ভাবি, অনুবাদ করবো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ। বাংলা ভাষাতেই। নিজের মতো করে।
বাংলা ভাষার অনুবাদ বাংলাতে!
বিষয়টা কি পাগলামী? মুর্খতা?
হতে পারে। জানি না।
তবে চারপাশ দেখতে দেখতে, চারপাশ শুনতে শুনতে; চারপাশ পড়তে পড়তে, চারপাশ ভাবতে ভাবতে,
শুনি- কেউ বলছে; আমি না- আমারই ভেতর থেকে কেউ আমাকেই বলছে;
“কিছু জিনিষ থাকে, তাকে ঐ জায়গায় রেখে দিতে হয়। নাড়াচাড়া করতে হয় না। ভেবো না- অনুবাদটা করো।’
‘কার জন্য?’-
‘মনে করো কারও জন্য নয়; তোমারই জন্য।’
অনেকদিন ধ’রে ভাবছি, এই যে বাংলা আমার ভাষা; এই ভাষাটা আসলে জানাই হলো না। জানতে চাইলামও না কোনদিন। ‍নিজের ভাষার ব্যাকরণটা একটু জানা উচিত। এই চিন্তা থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ পড়তে শুরু করেছি। পড়তে গিয়ে মনে হলো;
মন্দ কী, এই দিয়ে শুরু হোক।।।


মন্তব্য

Unknown এর ছবি

সত্যিই অসাধারণ!

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, সুন্দর লিখেছেন।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।