পথের মোড়ে

জি.এম.তানিম এর ছবি
লিখেছেন জি.এম.তানিম (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০৫/২০২২ - ৫:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতাটার খোঁজ পেয়েছিলাম খোমাখাতায়, সচল দ্রোহীর একটি মন্তব্যে। কবিতাটা পড়ে মনের মধ্যে একটি অস্থিরতা শুরু হলো, বুকটা কোথায় যেন ধক করে উঠল। মন চাইছিল নিজের মতো করে, নিজের ভাষায় সেই গল্পটা ছড়িয়ে দেওয়ার। তাড়াহুড়ো করেই তাই অনুবাদের চেষ্টা করে ফেললাম। মূল কবিতাটা পাওয়া যাবে এখানে

পথের মোড়েই বন্ধু আমার থাকে
এই সীমাহীন শহরের কোলাহলে।
দিন চলে যায়, চলে যায় সপ্তাহ,
বছর গিয়েছে কত বেখেয়ালে চলে,
তবুও হয় না দেখা বন্ধুর মুখ
জীবনের মতো দ্রুত, বিচ্ছিরি দৌড়ে।
জানে আমি তাকে পছন্দ করি ঢের,
যেমন নেড়েছি কড়া রোজ তার দোরে,
সেও এসেছিল দরজায়, শৈশবে।
এখন আমরা ব্যস্ত, ক্লান্ত লোক,
ক্লান্ত- খেলতে একটি বোকামি খেলা,
ক্লান্ত- বানাতে নিজের নামফলক।
ভাবি, ঠিক তাকে করবো কালকে ফোন;
বুঝবে সে তবে, তার কথা মনে পড়ে।
কাল এসেছিলো, আরো কাল চলে গেলো,
শুধু আমাদের দূরত্ব গেল বেড়ে।
রাস্তার মোড়ে, তবুও মাইল দূরে...
"টেলিগ্রাম, স্যার..."
"জিম আর নেই বেঁচে।"
এই আমাদের কপালের পরিণাম
পথের মোড়ের বন্ধু মিলিয়ে গেছে।
-১১ ই মে, ২০২২
মূল কবিতাঃ Around the Corner by Charles Hanson Towne


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর কবিতা এবং চমৎকার অনুবাদ । ধন্যবাদ ।

নাজমুছ ছাকিব

জি.এম.তানিম এর ছবি

ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

তারাপদ রায়ের 'একজন্ম' আরো সংক্ষিপ্ত, তবু আরো তীব্রভেদী!

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

জি.এম.তানিম এর ছবি

খোমাখাতার আলাপটি তারাপদ রায়ের এই কবিতার বিষয়েই শুরু হয়েছিল। হাসি

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

তারেক অণু এর ছবি

কী নির্মম! ছুঁয়ে গেল হে-

জি.এম.তানিম এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

মন মাঝি এর ছবি

কবিতাটা পড়ে, বিশেষ করে তারাপদ রায়েরটা পড়ে পুরনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। আমিও সেই শৈশব থেকে কত বন্ধু হারিয়েছি। কেউ এই পৃথিবীরই কোনো মোড়ে আছে এখনো, কেউ পৃথিবী ছেড়েই চলে গেছে অন্য কোনো অচেনা মোড়ে। যারা চলে গেছে তাদের সাথে তো হবেই না, যারা এখনো আছে কোথাও তাদের সাথেও মনে হয় না আর কোনোদিন দেখা হবে এই জীবনে। এদের কারো কারো কথা কেন জানি এখানে লিখে রাখতে ইচ্ছে করছে খুব।

মনে পড়ে যায় অনীতার কথা। আয়তকার কালো ফ্রেমের চশমা আর ফ্রক পরা ৪ বছরের ছোট মেয়েটির ভীষণ কিউট মায়াবী মুখটা মনে পড়ে যায়। আগুনে পুড়ে ভাজা-ভাজা হয়ে গিয়েছিল বেচারি। কত দুষ্টুমি করতাম আমি ও অন্যান্য পিচ্চিপাচ্চারা তার সাথে। বাসা বদলের কারনে অন্য পাড়ায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু একই শহরেই তো ছিলাম। ভেবেছিলাম দেখা তো হবেই। কিন্তু হঠাৎই একদিন খবর পেলাম সমবয়সী কাজের মেয়েটার সাথে রান্নাঘরে "রান্নাবাটি" খেলতে গিয়ে পরে থাকা "শাড়িতে" নাকি আগুন লেগে গিয়েছিল। বাড়িতে বোধহয় বাবা-মা কেউ ছিলেন না। খবর পেয়ে বাবা ফিরে এসে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাঁচেনি। বোঝা যায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে দীর্ঘ সময় বোধহয় বেঁচে ছিল মাছ ভাজার মত। দপ করে জীবন থেকে একটা কচি মুখ কিভাবে যে মুছে গেল বিশ্বাসই হতে চায় না। নিজের জীবনের আরেক প্রান্তে এসে ঐ শুরুর কচি মুখটা কেন যেন বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকলে অনীতা আজ নিজেই হয়তো তখনকার নিজের মত একাধিক কচিকাচা নাতিপুতির নানি-দাদি হত আজ - কে জানে! কিন্তু না, তার সেই রূপ দেখার সুযোগ হবে না আমার বা আর কারোরই। বুকের মধ্যে সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরা কচি মুখটাই শুধু ফ্রেমবন্দী হয়ে থেকে যাবে আমৃত্যু। কোনোদিনও বয়স বাড়বে না। কিন্তু আমি ও আমরা যারা তাকে চিনতাম, তারা মরে যাওয়ার পর ওর কি হবে? আমাদের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেলে ওর সেই স্মৃতিরূপী মুখটা কার আশ্রয়ে থাকবে তখন? এই কথাটাও দংশন করে আমাকে মাঝেমধ্যে!!!

মনে পড়ে যায় করাচির কুইন্স রোডের বাসায় সিন্ধি প্রতিবেশীর ছেলে মিনুর (?) কথা। ৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীণ হয়ে যাওয়ার পরে যার বাবা-মা আমার সাথে মেলামেশার ব্যাপারে তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এর সাথেও আর কোনোদিন দেখা হবে না। তবে এনিয়ে অবশ্য আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। হা হা হা... মনে পড়ে ঐ বাড়িতেই আমার থেকে বোধহয় ৫-৬ বছরের বড় একটি মেয়ে নাসেরার কথা। এ অবশ্য আমাদের বাড়ির সিন্ধী দারোয়ানের মেয়ে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানে সেইই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। এদের কাছে আমি আমাদের চরম সিক্রেট - পাকিস্তান থেকে পালানোর প্ল্যান ফাঁস করে দিয়েছিলাম!!! আমি নাকি "হামলোগ পালায়ে যায়েগা..." দিয়ে শুরু করে বিরাট কাহিনি ফেঁদে বসেছিলাম। সেটা ওদের বলার সময় আবার আম্মা শুনে ফেলেছিলেন। কিছু হয়নি অবশ্য, কিন্তু পরে আম্মার কাছে দীর্ঘকাল এই "হামলোগ পালায়ে যায়েগা..." ডায়ালগটার মিমিক্রি শুনতে হয়েছে। গড়াগড়ি দিয়া হাসি
নাসেরার সাথেও দেখা হবে না কোনোদিন।

মনে পড়ে পাকিস্তান থেকে ৭২-এর কোনো এক সময় জীবন হাতে নিয়ে পালানোর সময় আফগানিস্থান-পাকিস্তান বর্ডারের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে (কিম্বা হয়তো কান্দাহারে) মাউথ-অর্গান বাদক সহযাত্রী টুটুলের কথা। আমার থেকে কয়েক বছরের বড় ছিল মনে হয়। ওর মাউথ-অর্গানটার উপর আমার ভীষণ নজর পড়ে গিয়েছিল। টুটুলের সাথেও দেখা হবে না কোনোদিন।

মনে পড়ে যায় করাচিতে বাঙালী পরিবারের আরও জনা দশেক ছোটবড় পিচ্চিপাচ্চার কথা। মাঝেমধ্যে আমরা একসাথে হুল্লোড় করে ক্লিফটন বা হক্সবে বীচে যেতাম, আরব সাগরে হাবুডুবু খেতাম। প্রায় একই সাথে এবং বোধহয় একই পথে পালিয়েওছিলাম পাকিস্তান থেকে। তবে বিভিন্ন ব্যাচে বা গ্রুপে। মজার ব্যাপার হল, প্রায় সবাই ঢাকায় ফিরে একই জায়গাতেই উঠেছিলাম। দেশে ফিরেও কয়েক বছর একসাথেই ছিলাম। কিন্তু সেই শেষ। এরা সবাইই বোধহয় নিজেদের জীবনে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত কোনো না কোনো মোড়ে। কোথায় আছে জানি না, কোনো যোগাযোগ নেই, তাগিদও নেই, দেখাও বোধহয় হবে না আর কোনোদিন। যেদিন আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব, একে অপরের কথা জানবও না। কেউ ইতিমধ্যেই চলে গেছে কিনা জানি না।

মনে পড়ে যায়, ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলের ক্লাস টুর মনিরা আর থ্রির রাকিব আর নাইমুলের কথা। মনে পড়ে ক্লাস-এইট-নাইন-টেনের হোস্টেল জীবনের বন্ধু সাদিক-অতনু-দুর্গেশ-শাহনেওয়াজ-নুরুজ্জামানের কথা। কত ঝগড়াঝাটি আর এডভেঞ্চার হয়েছে একসাথে! পৃথিবীর কোন মোড়ে কোথায় আছে তারা এখন জানি না। মনে হয় না দেখা হবে আর কোনোদিন। এরপর কলেজ-ইউনির আশিষ-তারেক-লিপি কে কোথায় জানি না। মনে হয় না আর জানব কোনোদিন। এরপরও জীবনের বিভিন্ন মোড়ে বন্ধুত্ত্ব হয়েছে আবার মোড় ঘুরে ভিন্নপথে চলে গেছি কিম্বা কবিতাটার মতই --

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

****************************************

জি.এম.তানিম এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার স্মৃতিচারণের জন্য। এই মন্তব্যটাই একটা পুরো পোস্ট হতে পারতো। কতো কতো ফেলে আসা স্মৃতি জীবনের!

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।