দুঃস্বপ্ন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৭/১১/২০১৫ - ৯:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইভানের ঘরের জানালাটা বেশ বড় । বাড়ীটা ওর দাদার আমলের, বর্তমানে এরকম জানালাওয়ালা বাড়ি কোথাও দেখাই যায় না । জানালা টা খুললেই দূরের পাহাড় আর বড় বড় গাছের সারি দেখা যায় । যে কারোরই এমন সুন্দর দৃশ্য দেখতে ভাল লাগবে । তবে ইভান সব সময় জানালাটা বন্ধ করে রাখে এবং পর্দাও নামিয়ে রাখে । এর পেছনে জটিল কোন কারণ নেই, এইসব সৌন্দর্য তার কাছে পুরোপুরি অর্থহীন, এই যা । তবে আজ জানালা খোলা এবং সে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত । আজকে বাইরে খুব বাতাস হচ্ছে, ভেজা আর ঠাণ্ডা বাতাস । বাতাস আর ভেজা বাতাসের মাঝে অনেক পার্থক্য । এটা ইভান আজই প্রথম বুঝল । আকাশ তেমন মেঘলা না তবে একটু পরই যে বৃষ্টি হবে এটা বোঝা যাচ্ছে । দূরে পাহাড়ে গাছ গুলোর সবুজ রঙটা আজকে খুব বেশি চোখে পড়ছে । স্কুলে সে পড়েছিল যে সবুজ রঙ চোখকে স্বস্তি দেয়, তখন সে সেটা আমলে নেয়নি কারণ স্কুলে সবাই যেরকম নম্বর পাবার জন্য পড়ে সেও তাই করেছে । এই ব্যাপারটি কখনও পরীক্ষায় লিখতে হয়নি তাই এটা নিয়ে ভাবারও দরকার পড়েনি । যাই হোক বাতসের সাথে সাথে গাছ গুলো দুলছে । গাছগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম এর মধ্যে দুলছে, একটি গাছও নিয়মের বাত্যায় ঘটাচ্ছে না । গাছেরাও নিয়ম মেনে চলে, কি অদ্ভুত । ইভানের চুলের ফাঁক গলে বাতাস চলে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । জীবনের এই সুন্দর মুহূর্তগুলো আগে কখনই সে সেভাবে উপভোগ করেনি । করতে চেষ্টাও করেনি । তবে দুঃখের ব্যাপার হল সে হয়ত আর বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারবে না । আর ত্রিশ মিনিট, খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা । এর বেশি নয় । সে কিছুক্ষন আগেই তিয়াত্তর টি স্লিপিং পিল খেয়েছে । প্রথমে পঞ্চাশ টির মত খেতে চেয়েছিল তবে তাতে যদি সে বেঁচে যায় এবং পরে সবাই যদি তার এ কাজের কথা জেনে যায় তাই নিশ্চিত করার জন্য আরও তেইশটি বেশি খেয়েছে । তিয়াত্তরটি তে কাজ হবার কথা কারণ এটা দুটা খেলেই সে প্রায় ছয় ঘণ্টার মত নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে । তবে এখন তার ভয়ঙ্কর অনুশোচনা হচ্ছে । জীবনের ভয়ঙ্কর খারাপ সব অনুভুতির সাথেই সে পরিচিত, তবে তার কোনও কাজ নিয়েই তার কখনও অনুশোচনা হয়নি বলে এই অনুভূতিটি নতুন । অনুশোচনার কারণ স্লিপিং পিল নয়; জানালাটা সে খুলতে গেল কেন? জানালা না খুললে হয়ত তার আর এক মিনিট ও বাঁচতে ইচ্ছে করত না কিন্তু এখন ব্যাপারটি অন্য রকম । এরই মধ্যে সে তন্দ্রা অনুভব করতে শুরু করেছে । ইস আরও কিছুক্ষণ যদি দেখা যেত! পাহাড়, গাছ, আকাশ… … …। ঠিক তখনই ইভান রুমের দরজাটা খোলার শব্দ পেল । ঘুরে তাকিয়ে দেখল রাতুল দাঁড়িয়ে আছে । রাতুল ইভানের কাজিন । তারা ছোটবেলা থেকে একসাথেই বড় হয়েছে । ছোটবেলা থেকেই ইভান তার বাসার কাউকেই পছন্দ করত না, পছন্দ করার অবশ্য কোনও কারণও ছিল না । পছন্দ শব্দটি এখানে ঠিক যাচ্ছে না । মূলত সে তার বাসার সবাইকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত; একমাত্র রাতুল কে ছাড়া ।
রাতুল দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে । তার ডান হাতে একটি বড়সড় ছুরি । ছুরিটাতে এর আশপাশের সবকিছুই প্রতিফলিত হচ্ছিল । সাধারণত দূর থেকে দেখে ছুরি ধারালো কিনা সেটা সবসময় বোঝা যায় না । তবে এক্ষেত্রে স্পশতভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে এটা বেশ ধারালো । রাতুল একটু একটু করে ইভানের দিকে এগিয়ে আসছে । খুব ধীরে । ইভানের চোখও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে… … … … … ধীরে ধীরে…. … … … … খুব ধীরে… … … …

২.
ইভান বিছানায় হুড়মুড় করে উঠে বসলো । আবারো সেই বাজে স্বপ্নটা । এই স্বপ্নটা ইভান চার পাঁচ মাস ধরে নিয়মিত বিরতিতে দেখে আসছে। বাজে স্বপ্নে্র সাথে সে বেশ পরিচিত । কারণ তার কাছে স্বপ্ন যা দুঃস্বপ্নও তা-ই । তবে একই স্বপ্ন বারবার দেখাটা নতুন অভিজ্ঞতা । এর পুনরাবৃত্তি কিছুটা দৃষ্টিকটুই ।
বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছে । জঘন্য ! সত্যি এই বৃষ্টি জিনিসটা খুবই বিরক্তিকর । গাড়ি থেকে ঠিকমতো বেরও হওয়া যায় না, মুহূর্তেই জামাকাপড় ভিজে যায় । যত্তসব ফালতু । কিছু আঁতেল লোকজন যখন বর্ষাকালের প্রতি তাদের লোক দেখানো ভালবাসার কথা বলে তখন ইভানের তাদেরকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে । তাকে এখন বের হতে হবে । আজ সে বেশ বড় একটি বিজনেজ ডিল করতে যাচ্ছে । তার সাথে রাতুলেরও যাবার কথা । একসময় রাতুল ইভানের খেলার সাথি, সহপাঠী, বন্ধু সবই ছিল । এখন সে তার বিজনেজ পার্টনার । এ কারনেই কিনা বন্ধুত্তেও কিছুটা ভাটা পড়েছে । সে তার সাথে একই বাড়িতে থাকে । বাড়িটাতে শুধু ওরা দুজনই ।
ব্রেকফাস্ট করার সময়টা ইভানের খুবই অসহ্য লাগে কারণ রাতুলও তার সাথেই ব্রেকফাস্ট করে । একটা সময় ছিল, যখন রাতুলের সাথে একই টেবিলে খাবার সময়টাই ইভানের কাছে দিনের সেরা মুহূর্ত মনে হত । এখন সব অন্য রকম । বিজনেস পার্টনার হবার পর অন্য সব কিছুর মত এটাও পাল্টেছে । বিজনেস এর ক্ষেত্রটা খুবই নিষ্ঠুর । এটা ইভানের উপলব্ধি । এখানে প্রফিটই শেষ কথা । সবার চেয়ে বেশি প্রফিট পেতে যদি কাউকে ধ্বংস করতে হয় তো তাই করতে হবে । এটাই বিজনেজ ।
বাইরে বৃষ্টি থেমেছে । রোদও উঠে গেছে, অদ্ভুত আবহাওয়া । ইভান রাতুলকে নিয়ে গ্যারেজের দিকে যাচ্ছিল । বাগানে আগাছাগুলো অনেক দিন না কাটায় বাগানটা আর বাগান নেই; জঙ্গলে পরিণত হয়েছে । বাড়িটার দায়িত্ব ইভানের কাঁধে আসার পর থেকেই অবশ্য বাগানটার রীতিমত যাচ্ছেতাই অবস্থা । তার কাছে এসব বাগান টাগান এর কোনও দাম নেই । সুইমিংপুলটারও পানি বদলাতে হবে । গ্যারেজের বাম পাশের টেনিসকোর্ট টাতে পাতা পড়ে খুব বাজে অবস্থা হয়েছে । সে এসব ভাবছিল আর মনে মনে তার দাদা আর বাবা কে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল । তার দাদা কিংবা বাবা কে তো আর এইকাজ গুলো নিজ হাতে করতে হয়নি; তারা তো দরকারে অদরকারে প্রতিটি কাজের জন্যই একগাদা লোক রেখেছিল । তারা আলিশান জীবনের জন্য তাদের সব ব্যবসাই একটি একটি করে ধ্বংস করেছে । আর এখন ইভানকে যদি এত লোক রাখতে হয় তাহলে হয়ত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে পথে বসতে হবে । পথে অবশ্য তাকে একদিন বসতেই হবে । তার পূর্বপুরুষরাই সে ব্যবস্থা করে রেখেছে ।
যাই হোক দুটি গ্যারেজের বাম পাশেরটি ইভানের । সে তার গাড়িটা বের করল । একসময় তার অনেক ভাল একটি গাড়ি ছিল । তবে তাকে সেটা বিক্রি করে দিতে হয়েছে । ইভান আর রাতুল একই বিজনেজের পার্টনার, গত বছর সেটাতে খুব বড় লোকসান হয়েছিল । ইভানকে তার গাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে তবে রাতুলকে তার ঘড়িটাও বেচতে হয়নি । সে এখনো রাজার হালে ঘুরে বেড়ায় । কিন্তু কিভাবে? এধরনের কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন ইভানের মনে সারাক্ষনই ঘোরে ।
বৃষ্টিভেজা রাস্তায় গাড়ি চলছে । ইভান ড্রাইভিং সিটে পাশে রাতুল । রাতুলের গাড়িতে কি যেন সমস্যা হয়েছে তাই সে ইভানের সাথেই যাচ্ছে । গাড়ি চালাবার সময় ইভানের বারবার ঐ স্বপ্নটার কথা মাথায় ঘুরছিল । সে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করল । সে যতবারই এই স্বপ্নটা দেখেছে ততবারই ঘুম থেকে উঠে দেখেছে যে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে । প্রত্যেকবারই ।
তখন তার দেখা অন্য আরও স্বপ্নের কথা মনে পড়ছিল । অনেক সময় স্বপ্নের কিছু মুহূর্তের সাথে পরে বাস্তবের কিছু মুহূর্তকে সে হুবহু মিলে যেতে দেখেছে । এটা ওর একেবারে বাস্তব অভিজ্ঞতা । তবে সেটা খুবই অল্পসময়য়ের জন্য । এটা সে কাউকে বলেওনি । সে অবশ্য কিছুই কাউকে বলেনা ,কারণ তার কথা বলার জন্য কেউই নেই । যাই হোক এই স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হবার কোন কারণ নেই । সে এখনো অতটা কাপুরুষ নয় যে আত্মহত্যা করবে ।

৩.
মিটিং রুমে ইভানদের সাথে আরেকটি পক্ষের আলোচনা চলছিল । তারা একটি বড় ব্যবসা ডিল করতে যাচ্ছে । বেশ স্পর্শকাতর । রাতুলের কথাবার্তা শুনে ইভান মাঝেমাঝেই ভুলে যাচ্ছিল যে রাতুলই তার পার্টনার । তার মনে হচ্ছিল রাতুল বুঝি ঐ পক্ষের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে । আজ ইভানের ক্ষমতা থাকলে সে রাতুলকে তার ব্যবসা থেকে ছুঁড়ে ফেলত । কিন্তু এত বড় ব্যবসার জন্য পর্যাপ্ত ক্যাপিটাল তার নেই । অন্য সবসময়ের মতই ইভান তার সব রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি চেপে গেল । এটা সে ছোটবেলা থেকেই করে আসছে । ছোটবেলায় সে যে পরিবেশে বড় হয়েছে সেখানে তাকে সবকিছু চেপে যাওয়া বা মেনে নেয়ার নিয়মিত অনুশীলন করতে হত। যথারীতি সম্ভব সব সুযোগসুবিধা ঐ পক্ষকে দিয়েই চুক্তিতে সই করল তারা ।

গাড়িতে ইভানকে রাতুল বলল ,”তুমি অত চিন্তা কোরো না, লস যদি হয় তবে দুজনের একসাথেই হবে”
“ও আচ্ছা”, বলল ইভান ।
“ওরা অনেক বড় ব্যবসায়ী, বেশি দেন দরবার করলে হয়ত আমাদের সাথে ভেনচারে আসতে চাইবে না। তাতে আমাদেরই ক্ষতি”,বলল রাতুল ।
“ও”,বলল ইভান।
রাতুল সারা রাস্তাজুড়ে অনেক কথাই বলল তবে কোনটার উত্তরের জন্যই ইভান দুই অক্ষরের বেশি কোন শব্দ ব্যবহার করেনি ।
বাসায় ফিরে ওরা যে যার ঘরে চলে গেল । ইভান তার ইজি চেয়ারে প্রায় দেড় ঘণ্টা ঝিম মেরে বসে থাকল। তার মাথায় ছোটবেলা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার হাইলাইটস চলছিল । বেশিরভাগই খুব বাজে । তবে অনেক খুঁজে ভাল কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ল । ছয় বছর বয়সে একবার মা বাবার সাথে প্যারিসে গিয়েছিল । ছোট ছিল বলে তখন কিছুই বোঝেনি । মোনালিসার ছবি দেখে সে খুব অবাক হয়েছিল । এমন সাধারন একজন মহিলার ছবি দেখে সবার এত মাতামাতি করার কোন কারণ সে তখন খুঁজে পায়নি, যদিও এখনো খুব একটা পায় না । আরও কয়েকটি ঘটনা মনে পড়েছিল তবে আবার ভুলে গেছে ।
ইভানের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল রাতুল ।
“আমি একটু বের হচ্ছি, ফিরতে হয়ত দেরি হবে “,বলল রাতুল ।
ইভান মনে মনে খুশি হল । ফিরতে দেরি হবে মানে আজ রাতে আর ফিরবে না । হয়ত কাল সকালে বারটেন্ডার এসে ওকে দিয়ে যাবে । এই ধরনের কথার সাথে সে একদম ছোটবেলা থেকেই পরিচিত । তার মা-বাবা, দাদা কিংবা তার কাকা-কাকি অর্থাৎ রাতুলের বাবা-মা ওরা যখন বলত যে ফিরতে দেরি হবে তার মানে সেদিন তারা ফিরবে না । রাতুলও ওরকমই হয়েছে । তবে এদিক থেকে ইভান নিজেকে নিয়ে গর্বিত । সে রাত আড়াইটা বাজার আগেই বাসায় চলে আসে । অন্তত অন্য কাউকে তাকে বাসায় এনে দিতে হয় না ।
রাতুল আজ আর আসবেনা এটা নিশ্চিত হবার পর ইভানের মন খুব ভাল হয়ে গেল । আজ আর ওর সাথে বসে রাতের খাবার খেতে হবে না । তার মাঝেমাঝেই ইচ্ছে হয় রাতুলকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে । তবে তা সম্ভব নয় । তার মত রাতুলও এর উত্তরাধিকারি।

৪.
কিছুদিন ধরেই ইভান একটি বিরক্তিকর রুটিন এর মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে । সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয় । নতুন ব্যবসাটা কেমন যেন ঠিকমতো শুরু হবার আগেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে । তাই তাকে খুব খাটতে হচ্ছে । পাঁচটার পর, বাড়ি ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে ইজি চেয়ারে বসে থাকে । সবসময়ের মতই এই সময় ইভানের মাথায় অতীতের হাইলাইটস চলতে থাকে । সাথে হাজারো বিচার বিশ্লেষণ । তবে কখনই কোন শেষবাক্যে পৌঁছাতে পারেনা । এটা তাকে আরও ক্লান্ত করে দেয় । এরপর দশটার দিকে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়; আসে দুটার দিকে । আর গাড়ি চালিয়ে আসার সময় রাস্তায় একেক দিন একেক গাছ কিংবা বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা খায় । তার গাড়ির সামনের দিকের অবস্থা খুব শোচনীয় । বাসায় এসে ঘুম, এভাবে একই চক্র চলতে থাকে ।
একটি জিনিষ সে একদম সহ্য করতে পারে না । সেটা হল রাতুলের সুখে শান্তিতে হেসে খেলে ঘুরে বেড়ানো । সে যখন তার চারপাশের এই বিরক্তিকর, অসহ্য পরিবেশে তীব্র মানসিক চাপ নিয়ে সময় কাটাচ্ছে তখন আরেকজনের মন কিনা এত ফুরফুরে । ইভান এখন রাতুলকে মন প্রান দিয়ে নিষ্ঠার সাথে ঘৃণা করে । তবে ঘৃণা ব্যাপারটা কখনই একমুখী হয় না, এটা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া । কিন্তু রাতুলের মুখের ত্যালতেলে বিশ্রী হাসি কিংবা তার কথাবার্তা থেকে ইভানের কখনই মনে হয়নি যে রাতুল তার ওপর ক্ষুব্ধ ।
এরই মধ্যে একদিন ইভান বারে বসেছিল । অনেকক্ষণ ধরে । আজ এখানে তেমন কেউই নেই । শহরে আজকে একটি বড় কনসার্ট হচ্ছে । এখানের কাজটা ওখানেই সারা যাবে বলে হয়ত কেউ আর কষ্ট করে এতদূর আসেনি । ইভানের মাথায় তখন ছোটবেলা থেকে জেনে আসা কিছু চূড়ান্ত অর্থহীন কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতক্ষনেও ওগুলো মাথা থেকে বেরচ্ছে না । তাদেরকে সবসময় শেখানো হয়েছে যে গুরুজনকে শ্রদ্ধা করতে হবে, আর সেই গুরুজন যদি মা-বাবা হয় তাহলে তো কথাই নেই; শ্রদ্ধা-সন্মানের ভারে একেবারে গলে যেতে হবে । মাটিতে মিশে যাবার আগ পর্যন্ত গলতে থাকতে হবে । শ্রদ্ধা-সন্মানের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের জন্য ধ্রুবক হয় কিভাবে । ইভান এক সময় রাতুলকে খুব পছন্দ করত কিন্তু এখন ঘৃণা করে; তো কি হয়েছে । সবকিছুই পরিবর্তনশীল মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধও এর বাইরে নয় । ইভানের জন্ম ওর মা-বাবার জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশমাত্র। এখানে তাদেরকে কোন বিশেষ অবদান বা কৃতিত্ব দেয়ার কিছু নেই । যদি কৃতিত্ব দিতেই হয় তো সৃষ্টিকর্তাকে দিতে হবে, তিনিই তার জন্মের নির্দেশদাতা । তার মা-বাবা কেবল উপলক্ষ মাত্র । কাজেই সে তার মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য নয় । যারা এইসব অর্থহীন কথাগুলো মানুষকে যুগ যুগ ধরে শুনিয়ে আসছে তারা যদি ইভানের জায়গায় থাকত তাহলে হয়ত মানুষ অন্য কিছু শুনে বড় হত।
ইভানের মাথায় সবকিছু এত দ্রুত ঘটছে যে সে কিসের পর কি চিন্তা করছে কিছুই ধরতে পারছেনা। চিন্তা, ঘটনা, বিচার, বিশ্লেষণ, সবকিছুর ব্যাখ্যা, উচিত, অনুচিত, ঠিক, বেঠিক সব মিলিয়ে ওর মস্তিষ্ক প্রচণ্ড রকমের ভারি হয়ে উঠেছে।
এরই মধ্যে ওর হঠাৎ এলভির কথা মনে পড়তে লাগল । এলভি তার এক সময়কার বান্ধবী । সে মানুষ হিসেবে অসাধারন ছিল । তবে ইভানের মা-বাবা এলভির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে ইভানকে অনেকটা বাধ্য করে ছেড়েছিল। এরই কিছুদিন পর ইভানদের ইউনিভার্সিটির এক ভয়ংকর বখাটে এলভিকে এতটাই বাজেভাবে জখম করেছিল যে এলভি ঠিক ওইদিন রাতেই মারা গিয়েছিল । এই পুরো ঘটনার জন্য ইভানের ঐ বখাটের ওপরই ক্ষুব্ধ হবার কথা; আশ্চর্যজনক ভাবে তা হয়নি । বরং সে তার নিজের মা-বাবার ওপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ খুঁজতে শুরু করেছিল । অবশ্য সে এটা কখনই করতে পারেনি । কারো ওপরই কোন প্রতিশোধ নিতে না পারার দুঃখ ইভানকে প্রতিনিয়তই তাড়িয়ে বেড়ায় ।
মাথায় এতসব কঠিন বিষয়ের সংঘর্ষের ফলে ইভান কাঁদতে শুরু করল । ওকে কাঁদতে দেখে দূরে দাড়িয়ে বারটেন্ডার হাসছিল । ইভান আর রাতুলকে সে অনেক দিন ধরেই চেনে । এরা দুজন দুরকম । রাতুল এখানে খুশিমনে এসে আরও হাজার গুন বেশি খুশিমন নিয়ে ফিরে যায় । আর ইভান মন খারাপ নিয়ে এসে আরও বেশি মন খারাপ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরে । বারে কাজ করতে করতে এইসব দৃশ্য দেখা খুব মজা । তবে সমস্যা হল মাঝেমাঝে কাস্টমারদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয় । কারণ বার থেকে বের হয়ে এদের বেশিরভাগই নিজের বাড়িতে ফেরার পথ ভুলে যায় । এগুলো ভাবতে ভাবতে বারটেন্ডার হাসতেই থাকল, হাসি আর থামেই না, কিছুতেই থামে না।
এ এক এমনই জায়গা যেখানে একজনের কান্না দেখে অন্যজনের হাসি পায়, ঠিক তখনই হয়ত সেইজনের হাসি দেখেই আবার আরেকজনের কান্না পায় । সবই তরলের প্রভাবন ।

৫.
গ্যারেজে গাড়ি রেখে ইভান গাড়িতেই অনেকক্ষণ বসে থাকল । তার বাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না । তার শরীর আর চলছে না । যদি এমন হত যে সে চোখ বন্ধ করল আর খুলে দেখল যে সে তার বিছানায় ।
যাই হোক গাড়িতে তো আর বসে থাকা যায় না, তাই বের হয়ে বাসায় ঢুকল । ঢুকে দেখল ডাইনিং টেবিলের উপর একটি অর্ধেক পিৎজা খোলা পড়ে আছে, পাশে একটি কোকাকোলার ক্যান আর সসের বোতল; বোতলটা খোলা । এই দৃশ্য দেখে সে হঠাৎ চমকে উঠল । তার মনে হচ্ছে ঠিক এই একই দৃশ্য এই একই অবস্থাতেই সে আগেও দেখেছে । মনে হচ্ছে না, সে নিশ্চিত যে এটা সে আগেও দেখেছে । প্রত্যেকটা জিনিস ঠিক একইভাবেই রাখা । সে সোফায় বসে পড়ল । তাহলে কি এটা সে স্বপ্নে দেখেছে? সে বুঝতে পারছে না কোনটা স্বপ্ন, এখন যেটা দেখছে এটা নাকি আগে যেটা দেখেছিল সেটা ।
এইমাত্রই সে গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাসায় ঢুকল । আজ সে নির্বিঘ্নে গাড়ি চালিয়ে এসেছে কোথাও কোন সমস্যা হয়নি । মানে সে পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে।
তখন অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই ওর ছোটবেলার একটা স্বপ্নের কথা হঠাৎ মনে পড়ল । স্বপ্নটা অনেক বড় ছিল তাই স্বপ্নটির তেমন কিছুই তার এখন মনে নেই; একটি দৃশ্যই মনে আছে । সেটা ছিল এমন যে ইভান তাদের বাসার পেছনে টেনিসকোর্টের পাশের জায়গাটাতে একটি কুকুরকে মাটি চাপা দিচ্ছে ।
এটা শুধুই স্বপ্নই হতে পারত । কিন্তু এর পরই ইভানের যে কথাটি মনে পড়ল সেটার পর সে আর কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারছিল না ।
বছর দুয়েক আগে ইভানের পোষা লাব্রাডর সিকিটি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । ডাক্তার দেখিয়ে, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েও তাকে সুস্থ করতে পারেনি । সিকিটি খুব কষ্ট পাচ্ছিল এবং দিনের পর দিন ভয়ংকর রোগা হয়ে যাচ্ছিল । সিকিটি সারাদিনই কান্না করত । কুকুর যে সত্যিই কাঁদে এটা ইভান তখনই বুঝেছিল ।
তখনই একদিন ভয়ংকর বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় ইভানের মনে হল যে সে জীবনে তেমন কোন বিশেষ ভাল কাজ করেনি । তবে সে ইচ্ছে করলেই এখন করতে পারে । আর সেই ভাল কাজ হল সিকিটিকে এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি দিয়ে দেয়া । সে একটুও দেরি করল না । ওইদিন রাতেই সে সিকিটির খাবারে ধুতুরার বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল । আর ঘণ্টা খানেকের মধেই সিকিটি সব যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়ে গেল । আর এরপর ইভান খুশিমনে সিকিটিকে টেনিসকোর্টের পাশের জায়গাটাতে নিজ হাতে কবর দিয়েছিল । কবর দেয়ার পর থেকে শুরু করে পরবর্তী পনের দিন ইভানের মন খুবই ভাল ছিল; কারণ সে সিকিটিকে শান্তি দিয়েছে ।
ছোটবেলার ঐ স্বপ্ন আর এই ঘটনার মাঝে সময়ের ব্যাপক ব্যবধান । কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মাথায় সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে । ইভান কিছুই ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছে না । বারবার চিন্তার সুত্র হারিয়ে যাচ্ছে । এখনই এক পেগ পাসপোর্ট স্কচ খাওয়া ছাড়া মাথা ঠাণ্ডা করার আর কোন উপায় তার জানা নেই । ফ্রিজ খুলে দেখল সেটাও নেই। ষ্টোর রুমে খুঁজল সেখানেও নেই । ছোটবেলায় একটা প্রবাদ পড়েছিল বিপদগ্রস্ত মানুষ যেখানেই যায় সেখানেই কি একটা যেন হয়; কি হয় সেটা আর মনে পড়ছে না । আর উপায় না দেখে সে তিনটা স্লিপিং পিল খেল । এখন ঘুমাতে হবে; ঘুম না আসলেও । যত অচেতন থাকা যায় ততই ভাল । তবে তার ক্ষেত্রে ঘুমালেও সমস্যা; দুঃস্বপ্ন । এত শক্তিশালী তিনটি স্লিপিং পিলও ওকে ঘুম পাড়াতে পারছে না । ওর মস্তিষ্ক ওষুধের কাছে হার মানতে রাজি নয় । কিন্তু শেষমেশ মানতেই হল; ইভান ঘুমিয়ে পড়ল ।

৬.
অফিসে কাজ করতে করতে ইভান ভয়ংকর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । লাঞ্চ আওয়ার এর জন্য অপেক্ষা করছে। এই সময় অবশ্য ও কিছুই খায় না । চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।
ইদানিং ঐ স্বপ্ন সে খুব বেশি ঘন ঘন দেখছে । একসময় সে নিজেকে বুঝিয়েছিল যে তার দৈনন্দিন জীবনের বাড়াবাড়ি রকমের মানসিক চাপের কারনেই এটা হচ্ছে । তবে ইভান এখন নিজেই নিশ্চিত নয় যে মানসিক চাপের কারনেই সে স্বপ্নটি দেখছে নাকি এই স্বপ্নটির কারনেই তার ওপর এত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে । সবকিছু ধাঁধার মত লাগছে।
ওর মাথার একটা অংশ বলছে যে ওর একজন সাইকলজিসটের কাছে যাওয়া উচিত। তার কথা বলার যেহেতু কেউ নেই, কথা বলার জন্য হলেও যাওয়া উচিত । আবার আরেকটি অংশ বলছে যে সে কি এতই দুর্বল যে নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করতে পারছে না। এই দুই অংশের মধ্যে সংঘাত চলতেই থাকলো । শেষ পর্যন্ত প্রথম অংশটি জয়ী হল । সে সাইকলজিসটের কাছে যেতে মনস্থির করল।
রুমে প্রবেশ করার পর প্রথমেই সাইকলজিসট লোকটাকে দেখে ইভানের মেজাজ বিগড়ে গেল । তবে সে বুঝতে দিল না । বুঝলেই বা কি ।
দীর্ঘক্ষণ ধরে সে তার সব কথা বলল । সাইকলজিসটও অনেক কথা ওকে বলল । পুরো কথোপকথন শেষ হবার পর ইভান যখন বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসলো, তখন ওর এই উপলব্ধি হল যে সাইকলজিসট লোকটার নিজেরই আরেকজন সাইকলজিসট খুব প্রয়োজন । খুব বেশি প্রয়োজন ।

৭.
এত পরিশ্রম করার পরও ইভানের ব্যবসাটা খুব বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে । রাতুল তার পার্টনার হলেও তাকে দেখে এর কিছুই বোঝার উপায় নেই । সে তার জীবন উপভোগের জন্য কোন কিছুই বাদ দিচ্ছে না । ইভান অনেক কিছুই বুঝতে পারছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না । এটা অনেকটা পাগলা কুকুর ধাওয়া করছে জেনেও দৌড়াতে না পারার মত।
ইভানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটা একসময় অনেক বিখ্যাত ও প্রভাবশালী ছিল । তবে তার দাদার আমলেই শেষ দিকে এটি ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল । ইভানের বাবা এর কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকেছে । তিনি এই কাজটি খুব ভালভাবেই করেছেন যাতে এটি কফিন থেকে কিছুতেই বের হতে না পারে । আর ইভান এতদিন ধরে কফিনটা বয়ে কবরস্থানে নিয়ে এসেছে, কিছুদিনের মধ্যেই দাফন সম্পন্ন হয়ে যাবে।
ইভানের এখন কিছুই করার নেই । তাদের বিজনেজের পূর্বের রুপকথা ব্যাংক শুনতে চাইবে না । তাদের চারটি ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে গেছে । অর্ধেকের বেশি কর্মচারী নেই । শেষ সুযোগ হিসেবে ব্যাংক ইভানকে ঐ বিজনেজটা ডিল করার জন্য যে লোণ দিয়েছিল সেটা মুখ থুবড়ে পড়ায় ওটাও শেষ । সব ব্যাংকই ইভানকে ব্ল্যাক লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেছে ।
ইভানের মা-বাবা,দাদা সবাই তার সামনেই খুব দৃষ্টিকটু ভাবে তাদের পুরো জীবন উপভোগ করেছে । ইভান কোন এক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির কাছে শুনেছিল যে জীবন নাকি দ্বিতীয়বার পাওয়া যাবে না । তাই এখানে প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করা উচিত । সে অনুযায়ী তারা সবাই ঠিক কাজই করেছিল । কিন্তু ইভানেরও দ্বিতীয়বার জন্মাবার কোন কারণ নেই ।
ইভানের অবস্থা এখন রীতিমত শোচনীয় । তার গাড়িটিও আর নেই । ওটা তাকে পানির দামে বিক্রি করে দিতে হয়েছে । সে এখন আর ইচ্ছে করলেই বারে যেতে পারে না । এক সময় যেসব কাজ খুব সহজ মনে হত ওগুলোর কথা সে এখন ভাবতেই পারে না।
সে অনেক সুবিধাভোগী ওপরতলার হিপক্রেটের মুখে শুনেছে যে টাকাই জীবনের সব নয়; একটি উপাদান মাত্র । জীবনে আরও অনেক ভাল জিনিস আছে যেগুলোর মূল্য নাকি অনেক বেশি । গাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় পা না দিয়েই সরাসরি বেডরুমে পৌঁছে যেতে পারলে এগুলো বলাই যায় । তার বাবা দাদারাও বলত । অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকলে এসব মুখ থেকে খুব বের হয়, আর না থাকলেই কেবল কোনটা মূল্যবান আর কোনটা নয় তার পার্থক্য অনুভব করা যায়; এখন যেমন ইভান করছে ।

৮.
ইভান প্রতিদিন অফিসে গিয়ে দেখে তার রুমে তার আগেই ব্যাংক এজেন্টরা ইভানের টেবিল ঘিরে বসে আছে । সারাদিন এই দৃশের তেমন পরিবর্তন হয় না । এটাকে অনেকটা বয়স্ক রোগাক্রান্ত বা মুমূর্ষু কোন প্রাণীর সামনে এক ঝাঁক শকুন বসে থাকার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে । শকুন অপেক্ষা করে বসে থাকে কখন প্রাণীটি মারা যাবে আর তারা সেটার মাংস খাবে । এখানে মুমূর্ষু প্রাণীর জায়গায় ইভান আর শকুনের জায়গায় ব্যাংক এজেন্ট। তবে ব্যাংক এজেন্টরা যেহেতু মানুষ তাই তারা অন্তত ইভানকে খেয়ে ফেলবে না । কারণ মানুষ একমাত্র আরেকজন মানুষের মাংস খাওয়া ছাড়া আর সবই করতে পারে । আসলেই মানুষ শকুনের চেয়ে অনেক ভালই বটে ।
ব্যাংক এজেন্টরা ইভানকে হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত করে । কিন্তু এগুলোর কি উত্তর থাকতে পারে সেটা সে ভেবেই পায় না । সারাদিন ওকে এই প্রশ্ন এবং পাল্টা প্রশ্নের মাঝে কাটিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় । আগে তাও বারে যেত এখন সেই উপায়ও নেই। এখনো দিনশেষে ফেরার মত একটা বাড়ি আছে কিছুদিন পর সেটাও হয়ত থাকবে না ।
তবে ব্যাংক এজেন্টদের সাথে রাতুলের সম্পর্ক বেশ ভালই বলতে হবে । এসব ব্যাপারে ইভান কখনই রাতুলের সাথে কথা বলতে পারে না । সে দিনদিন মেরুদণ্ডহীন থেকে আরও মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ছে। সবকিছু অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার হচ্ছে; অন্ধকার ।
রাতের বেলা ইভানের হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল; কান্নার শব্দে । অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত । এখানে কাঁদবার মত কেউ নেই । রাতুল বার থেকে এসে আর যাই হোক কাঁদবে না নিশ্চিত । কিন্তু শব্দটা ওর খুব চেনা আগে কোথাও শুনেছে, কোথায় শুনেছে? হয়ত বা কোন স্বপ্নে। কারণ তাকে কখনও কান্নার শব্দ শুনতে হয়নি। ছোটবেলা থেকে তাদের বাড়িতে সবাই এতই উৎফুল্ল থাকত যে সে কখনই কাউকে কাঁদতে দেখেনি । কান্না যা আসার রাতুলেরই আসতো তবে কান্না চাপার ব্যাপারে সে বরাবরই সিদ্ধহস্ত । অনেকবার শোনার আর খোঁজাখুঁজির পর খুবই আশ্চর্যজনক একটি বিষয় সে আবিষ্কার করল । সেটা হল আর কেউ নয় সে নিজেই কাঁদছে । ওর বালিশ পুরোই ভেজা । চোখ পুরোপুরি ফোলা । এসব দেখার পর জীবনে এই প্রথম সচেতন অবস্থায় ইভান আর কান্না চাপতে পারল না। সে কাঁদছে তো কাদছেই, কান্না আর থামছে না। চোখ থেকে পানি ঢেউয়ের মত বের হচ্ছে । ওর হঠাৎ মনে হল ওর সব চিন্তা, রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি, হতাশা, দুঃখ সব চোখের পানির সাথে বের হয়ে যাচ্ছে । সেটা হলে ভালই হত ।
কিন্তু সেটা হল না । পরদিন সকালে এইসব অনুভূতিগুলো একসাথে আবার ওর মনের মধ্যে হাজির হল । এতসব অনুভুতি একসাথে অনুভুত হলে সেটাকে কি বলে? কিন্তু ইভান এর জন্য আলাদা কোন শব্দ খুঁজে পেল না । কেন খুঁজে পাচ্ছে না এজন্য ওর মেজাজ আরও বিগড়ে গেল।
ইভানকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে । এর মধ্যে সে যদি বড় অঙ্কের টাকা পরিশোধ না করতে পারে তাহলে তার একদা বিলাস-বহুল বাড়ি নিয়ে নেয়া হবে; বলাই বাহুল্য তাকে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে । আর কোন উপায় নেই । কারণ এই বাড়ীটা বিক্রি করলে যে টাকা পাওয়া যাবে সেটা দেনার পরিমানের তুলনায় হাস্যকর রকমের ক্ষুদ্র । আর রাতুলের হুঁশিয়ারী এটা বিক্রি করা যাবে না ।
এখন ইভানের জীবনে আর কোন অনিশ্চয়তা নেই ।কারণ অনেক ভেবে সে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে । সে অনুযায়ী কাজ করছে । তবে সে কখনই আত্মসমর্পণ করবেনা । সচেতন অবস্থায় ইভানকে তার এই বাড়ি থেকে কেউ বের করতে পারবে না ।

৯.
এপ্রিলের ১৩ তারিখ দুপুরের দিকে ইভান একটি কাল স্যুট পড়ল, ভেতরে অফ হোয়াইট রঙের শার্ট । হাতে কলেজে পড়ার সময় কেনা ঘড়িটাও পড়ল। এক সময় তার আরও ভাল ভাল ঘড়ি ছিল । কিন্তু এখন শুধু এটাই আছে ।
ড্রয়ার থেকে তার শেষ পারফিউটা বের করে দুই পাফ দিল । খুব সুন্দর সুবাস, রীতিমত অসাধারণ । এগুলো কিভাবে যে বানায় ও কখনই ভেবে পায় না । খুব সুন্দর করে অনেক দিন পর মাথার চুলগুলো আঁচড়াল । সে যে দেখতে সত্যিই সুদর্শন এটা অনেকদিন পর আজকে আবার মনে হল । ছোটবেলায় একবার তার এক স্কুল টিচার বলেছিলেন যে পড়াশোনা না পারলে সুন্দর চেহারা দিয়ে কিছুই হবে না । এটা ভেবে তার আজকে খুব হাসি পাচ্ছে । আজকে ওর মন খুবই ভাল । সব ভাল ভাল কথা মাথায় আসছে । এর কারণ হতে পারে তার সব সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া গেছে বলে । কাল থেকে সে আর কোন সমস্যারই মুখোমুখি হবে না।
বেশ কয়েকটা চকলেট খাবার পর ও সমস্যা সমাধানের কাজে লেগে পড়ল । অনেক কষ্ট করে এতগুলো যোগাড় করতে হয়েছে । কেউই দিতে চায় না । যাই হোক শেষ পর্যন্ত পেয়েছে এই যা । সে এক এক করে তিয়াত্তরটিই খেল । একটিও বাদ দিল না। দেবেই বা কেন; অনেক দামি । আর ওর তো টাকার সমস্যা চলছে । কাজ করতে প্রথমে কিছুটা হয়ত সময় নেবে । তাই ইভান ভাবল যে ওর ঘরের জানালাটা খুলে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকবে । এভাবে সময় পেরিয়ে যাবে, এরপর তো আর চিন্তা নেই ।
জানালাটা খোলার সাথে সাথে ঠাণ্ডা বাতাসের একটা ধাক্কা লাগল ওর মুখে । একদম শীতল স্পর্শ । ভেজা আর ঠাণ্ডা বাতাস । দূরে তাকিয়ে দেখল পাহাড় আর সবুজ গাছ। গাছগুলো দুলছে । এদিক থেকে ওদিক । কি সুন্দর ছন্দ । ইভানের দেখতে খুবই ভাল লাগছিল; খুব । কিন্তু হায়! সে তো আর বেশিক্ষণ এটা উপভোগ করতে পারবে না । এরই মধ্যেই ওর সব কেমন যেন ঘোলাটে লাগছিল । তার দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসা স্বপ্নের সাথে ওর জীবনের শেষ দৃশ্য মিলে যাচ্ছে । কিন্তু এই ব্যাপারগুলো সে এখন আর ঐভাবে অনুভব করছে না । হঠাৎ, অনেক আগের কথা মনে পড়তে লাগল । তবে অস্পষ্ট । ছোটবেলার কথা, বাবার কথা, মার কথা, দাদার কথা। কিন্তু সবকিছু খুব অস্পষ্ট । একদম আবছা । এরই মধ্যেই ইভানের ঘরের দরজাটা খোলার শব্দ পেল, ঘুরে তাকিয়ে দেখল রাতুল যেভাবে দাড়িয়ে থাকার কথা সেভাবেই দাড়িয়ে আছে; ডান হাতে ছুরিটাও আছে । কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না । ছুরিটা ডান হাতেই আছে, বাম হাতে নয় । প্রত্যেকবার স্বপ্নে সে এটা ডান হাতেই দেখেছে, তবে এগুলো কিছুই ইভান এখন আর মেলাতে পারছে না । রাতুল ওর দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে । ইভান আর চোখ খোলা রাখতে পারছে না । নিঃশ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে । ইভানের মনে হচ্ছে সে মা, বাবা, দাদা সবার কথা শুনতে পাচ্ছে, খুব দূর থেকে, অস্পষ্ট । রাতুল আরও এগিয়ে আসছে । ইভানের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে … … … … ধীরে ধীরে …. … … খুব ধীরে … … … … …

১০.
ইন্সপেক্টর পুরো বাড়ীটা ঘুরে দেখলেন । অসাধারণ নির্মাণশৈলী । বিশেষ করে সুইমিং পুল এর পাশের সিনেমা রুমটার কথা আলাদাভাবে বলতেই হয় । কিন্তু আসল কাজটাই তিনি করতে পারছেন না । ইভানের ঘর ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন আলামত পাওয়া যায় নি ।
ইভান ওর বিছানায় শুয়ে আছে । ওর বুক বরাবর ঠিক মাঝামাঝি ছুরিটা ঢুকে আছে । ছুরিটা এর আশপাশের সবকিছুই প্রতিফলিত করছিল । ইন্সপেক্টর একটা প্রশ্নের কোন উত্তরই খুঁজে পাচ্ছেন না । সেটা হল ইভানের মৃত্যু কি ছুরি ঢুকানোর পরই হয়েছে নাকি ছুরি ঢুকানোর আগেই সে মৃত ছিল । ইভানের ফরেনসিক টেস্টের ফলাফলই তাদেরকে এই প্রশ্নের মুখে দাড় করিয়ে দিয়েছে ।
এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ইভানই দিতে পারত । তবে একটি কথা সত্যি সেটা হল ইভানকে আর কখনই কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না, একই সাথে সবুজের সমারোহ বা ভেজা বাতাসের ছোঁয়াও সে আর কখনো পাবে না ।

রত্নদীপ তূর্য


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি পড়লাম রত্নদ্বীপ তুর্য। আমি বলবনা যে দারুণ তরতর করে এগিয়েছে আপনার গল্প, তবে থেমে থাকেনি। গল্পের আমেজটা টের পাওয়া যায় শুরু থেকেই। আমার একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে পাঠক হিসেবে। আশা করি ব্যক্তিগত ভাবে নেবেন না। প্রতিশব্দের ব্যাবহার গল্পকে বেগবান করে, লেখকরা এ বিষয়ে যত্নবান হলে আমরা পাঠকেরা উপকৃত হই। আপনার গল্পের প্রথম তিনটি বাক্যে 'দেখা' এবং 'দেখতে' শব্দ দুটি তিনবার এসেছে। পুরো গল্প জুড়েই শব্দের এমনতর প্রয়োগ চোখে পড়ে। লেখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

তূর্য  এর ছবি

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার পর্যবেক্ষণগুলো শুনে বুঝতে পারলাম আপনি বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়েছেন, এটা জেনে আমি সত্যিই অনুপ্রাণিত হলাম। এরকম গঠনমূলক সমালোচনাই শুনতে চাইছিলাম। এরপর থেকে লেখার সময় এই বিস্ময়গুলো মাথায় থাকবে। ধন্যবাদ।

ঠাহর এর ছবি

গল্পটা অনেক ভাল হয়েছে। মনে হলো, অনেক বছর পর একটা 'গল্প' পড়লাম। অনেক ধন্যবাদ।

তূর্য  এর ছবি

আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে আরো কিছু লেখার অনুপ্রেরণা পেলাম।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লেগেছে গল্প, আরও লিখুন।

শুভেচ্ছা হাসি

তূর্য  এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে। গল্পটা দুঃস্বপ্নের চেয়ে স্থবিরতার দিকেই বেশি ইঙ্গিত করে।

শুভেচ্ছা জানবেন।

স্বয়ম

তূর্য  এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লিখেছেন । দুঃস্বপ্ন আর বাস্তবতার দারুন একটি সমন্বয় ঘটেছে ।

তূর্য  এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

অন্ধ এলিয়েন  এর ছবি

গল্পের শব্দচয়ন,ভাষা,বিষয়বস্তু,বলার ধরন সবই গতানুগতিক। ছোট গল্প নিয়ে গোটা দুনিয়াজুড়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেসবের সাথে পরিচয় আরো নিবিড় করলে পাঠক আপনার কাছ থেকে ভালো গল্প পাবে বলে প্রত্যাশা রাখছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।