স্কুল ছুটি: পূর্ব থেকে পশ্চিম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩১/০১/২০১৯ - ৩:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কারণে-অকারণে কতো যে ক্লাস ছুটি পেয়েছি, তা' ঠাওর করে বলা অসম্ভব। আন্তঃস্কুল প্রতিযোগীতায় ফুটবল টিম পাশের নাম-সর্বস্ব স্কুলকে হারানোর ফলে যে আনন্দ পেয়েছি, ইহা উদযাপন করতে স্কুলের প্রধান ছুটি দিয়েছিলেন। ভারী বৃষ্টি বা নদীতে জোয়ারের ফলে রাস্তাঘট ডুবে যাওয়াতে আমাদের স্কুলে যেতে বিড়ম্বনা পোহাতে হবে ভেবে, প্রধান শিক্ষক স্কুল ছুটি দিয়েছেন। আমরাও যাতায়াতের বিড়ম্বনার কথা ভেবে পানিতে থৈ থৈ করা মাঠের মধ্যে ফুটবল নিয়ে কাড়িকুড়ি করে তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। কখনো, এলাকার গন্যমান্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদে ছাত্রদের ভারী হৃদয়ের অব্যক্ত কষ্টের কথা বিবেচনা করে প্রধান শিক্ষক ঐ দিনের জন্য স্কুল ছুটি দিয়েছেন। বিষয়টা এমন যে, ছাত্ররা এক দিনের মধ্যেই শোকের ধকল কাটিয়ে পাঠে মনোনিবেশ করতে পারবে! প্রধান শিক্ষকের ধারনাকে সত্য প্রমান করে সহপাঠিরা মিলে গন্যমান্য ব্যক্তির শোকে পাগলপ্রায় হয়ে সারা দিন স্কুলের মাঠে বল নিয়ে ছোটাছুটি করে কাটিয়েছি। শেষ বিকেলে বোগলের মধ্যে বই-খাতা নিয়ে বাসাতে ফিরে মুখ আষাঢ়ের মেঘের মতো থমথমে করে ঐ গন্যমান্য ব্যক্তির পরলোক গমনের ফলে আমাদের সমাজে যে সমূহ ক্ষতি হয়েছে, ইহা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছি। বলাই বাহুল্য যে, ঐ দিন এতোটা শোকে কাতর হয়েছি যে লেখাপড়াতে আর মন বসাতে পারিনি।

স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলেজে উঠেছি। মন চাইলে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠলাম, না-হয় দুপুর গড়িয়ে বিকেলে। কখনো ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি থাকে, আবার কখনো ক্লাস শিক্ষার্থীশূণ্য দেখে শিক্ষক ফিরে যান। পুত্র বড় হয়েছে ভেবে পিতা-মাতাও ক্লাসের খোঁজ নেয়াটা অনধিকার চর্চা বলে বিবেচনা করতে লাগলেন। পাঠ গ্রহণের অপার স্বাধীনতাময় এক জীবন! ক্লাস করব-কী করবনা, ইহা একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এমন করেই কলেজের সুসময় শেষ হয়ে গেল।

সময়ের প্রবাহে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু। হলে ফ্রী থাকি, ক্যান্টিনে স্বল্প পয়সাতে খাওয়া-দাওয়া করি। ছেলের লেখাপড়াতে সমূহ ক্ষতি হতে পারে ভেবে মাসের শুরুতেই পিতা-মাতা মাসোহারা পাঠিয়ে দেন। পকেটে টান না-থাকায় ভাবলেশহীন এক জীবন চলতে লাগল। যখন খুশি ক্লাসে যাই। ক্লাসে শিক্ষকের কথাবার্তা ভালো নালাগলে, তাঁদের সামনে থেকে গটগট করে হেঁটে বের হয়ে এসে গাছতলায় বসে চা খাই। কাউকে কোনো কিছু নিয়ে কৈফিয়ত দিতে হয় না। আহা কী চিন্তাহীন এক শান্তিময় জীবন! এমন শান্তির জীবনে অধিক প্রশান্তি নিয়ে এসেছিল কারণে-অকারনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া। দূরে কোথায়ও রাজনৈতিক গোলোযোগ দেখা দিয়েছে তো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ; জলপাই রঙের লোকজন ছাত্রদের চরথাপ্পর দিয়েছে, তো দুই মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সাথে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছাত্রদেরকে কটূ কথা বলেছেন, শুরু হল ছাত্র আন্দোলন। এ সবের সাথে ছিল আমাদের 'ইচ্ছা' বন্ধ। দু-চার দিন ক্লাস করে যখনই হাপিয়ে উঠতাম, তখন শলাপরামর্শ করে ক্লাস বয়কটের সিদ্ধান্ত নিতাম। এই ক্লাস বয়কটের সিদ্ধান্তের সাতে শারিরিক শক্তিতে বলিয়ান কয়েকজনের একটি দল তৈরি করা হতো। জনগনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে যে গুটিকতক বিশ্বাস ভঙ্গকারী ক্লাসের পথে পা বাড়াবে, তাদেরকে চেংদোলা করে ঐ এলাকাছাড়া করাই ঐ দলের একমাত্র কাজ। বলাই বাহুল্য, এই কাজে ঐ দলটি যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিল। অমন আয়েসী জীবন বেশি দিন টিকলো না। পাঁচ-ছয় বছরের শিক্ষা জীবন মাত্র আট বছরে শেষ করে নিজের অজ্ঞতা টের পেলাম। এই অজ্ঞতা ঢাকতেই পশ্চিমের পথে পাড়ি দিতে হল।

কিঞ্চিৎ অধিক বয়সে খাতা-পেন্সিল বগলে নিয়ে পুনরায় ক্লাসে বসা শুরু করলাম। সাতসকালে ক্লাস করি, গভীর রাতে পরীক্ষা দেই। বড় বড় ফোঁটা করে বৃষ্টি পরে, পেঁজা তুলোর মতো করে তুষার পরে, তুষার পরে চারিপাশে এক-দেড় ফুট সাদা কার্পেট জমে যায়, কিন্তু ক্লাস বন্ধ হয়না। তুষারের সাথে শীতল বাতাসের প্রবাহে তাপমাত্রা শূণ্যের চেয়ে তিরিশ-চল্লিশ ডিগ্রী নিচে নেমে যায়, কিন্তু পরীক্ষা চলতে থাকে। ক্যাম্পাসে নোবেল পদক বিজয়ী মহান এক মানব এসে দুই-চার কথা বলে। কিন্তু তাঁর কথা শুনতে ক্লাস-পরিক্ষা বাদ দিতে কারো মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। দেশের সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারি রাষ্ট্রপতি ক্যাম্পাসে এসে হাঁটাহাটি করেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম আগের মতোই চলতে থিকে। কী আজগুবি এক দেশ!

কথায় আছে বাঘের ঘরে ঘোগের বাস। মহান আমেরিকাতেও কখনো কখনো ঘোগ দেখা যায়। এখন আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে 'শীতল বায়ু প্রবাহ' নামক এক ঘোগ ঘোড়াফেড়া করছে। এই অতি শীতল বায়ু প্রবাহের ফলে দ্রুত শরীরের তাপমাত্রা নেমে যাওয়াই হচ্ছে উইন্ড-চীল। বর্তমানের উইন্ড-চীলের কারণে আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে এন্টার্কটীকার মতো ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। কোথায়ও কোথায়ও অনুভূত তাপমাত্রা শূন্যের থেকে ৫০-৬০ ডিগ্রী নিচে নেমে গিয়েছে। এই উইন্ড-চিল এতটাই ভয়ানক যে কয়েক মিনিটের মধ্যে শরীরের টিসু বা কোষ ঠান্ডাতে জমে শক্ত হয়ে যেতে পারে, যার ফলে শরীরের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটের নিচে নেমে যেতে পারে এবং শরীরে কাপুনী এবং স্মৃতি শক্তি লোপের সম্ভাবনা থাকে। সাথে, বাকশক্তি হারানোর ঘটনাও ঘটতে পারে। এই সমূহ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একদিনের বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, সাথে আমারটাও। দীর্ঘ দিন পরে অযাচিত এই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ যে কীভাবে উদযাপন করব তা ভেবে কূল পাচ্ছি না।


মন্তব্য

 এরিক এর ছবি

শেষ দুইদিন ধরে -৩০ এর মধ্যে ঘুরাঘুরি করতেসি, ক্যানাডাতে অবশ্য এই ঝড় আর ঠাণ্ডা নিয়ে অনেক হাসাহাসি হচ্ছে ।

সত্যপীর এর ছবি

ঘুম দেন।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লেখকের নাম কই?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

উদাস কিশোর এর ছবি

সামান্য রম্য,, আরো অনেক কাম্য ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

শুরুটা ভালো লেগেছে।

-আমিননোমান

অতিথি লেখক এর ছবি

উইণ্ড চিল মনে হয় কিছুটাআপনার মাথায়ও ঢুকেছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।