অলঙ্কার বাক্স রহস্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৪/১২/২০১৯ - ৮:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সম্প্রতি এক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আমার প্রতি স্নেহসিক্ত হইয়া একখানি অলঙ্কার বাক্স দান করিয়াছেন। মোড়ক খুলিয়া উহার চন্দ্রালোকের ন্যায় বিচ্ছুরিত ছটা আর খোদাই দেখিয়া চিত্ত বিগলিত হইয়াছিল। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম আমার মূল্যবান গয়নাগাটি বলিতে যাওবা কিছু আছে বলিয়া আমি মনে করি সেইগুলির তাবৎ খুঁজিয়া পাতিয়া ওই মোহণীয় বাক্স খানায় গুছাইয়া রাখিব।

সাজসজ্জা করিতে আমার প্রায়ই মন চায়। কিন্তু জাগতিক কর্মযজ্ঞে সময় করিয়া উঠিতে পারিনা। সংসারের বিবিধ কার্য-কর্ম সারিয়া, মাতৃধর্ম পালন করিয়া যেই রমণীরা মনোহর সাজে সাজিয়া গুজিয়া আসরে উপস্থিত হন আমি তাহাদিগের দিকে জুলজুল করিয়া তাকাইয়া থাকি। তাকাইয়া থাকি আর মনে ভাবি, ‘আহা’! যাহারা সাজিতে জানেন বা সাজাইতে পারেন তাহাদের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধাভক্তি। নারী হিসেবে আমার চোখে ও মনস্তত্বে অন্য যেকোনো সুসজ্জিত পরিপাটি নারী জাঁকজমক আর প্রভাবের উদাহরণ স্থাপন করে, আর সেই প্রভাবের আকর্ষণে যদি ব্যক্তিত্বের মিশেল থাকে তবে সেখানে চাষ হয় বিমুগ্ধতার আদিরূপ। পুরুষের মনস্তত্বে সুসজ্জিত পরিপাটি নারীর অবস্থান কোনখানে, এ ব্যাপারে কোনো আলোকপাত করিতে পারিবে কিনা জিজ্ঞাসা করিলে আমার স্বামী কোনো সদুত্তর দিলেননা। কখনো সখনো তিনি এমন নিরুত্তাপ হইয়া যান। কোথায় কখন কোন কথা বলিতে গিয়া আবার কোন বিপদ ডাকিয়া আনেন এমন ভয়ে তিনি ক্ষেত্রবিশেষে এহেন নিরুত্তরতার পরিচয় দেন বলিয়াই আমার ধারনা। তথাপি আকারে ইঙ্গিতে জানিতে পারিলাম তাহার কাছে পরিপাট্য সমাদৃত ও সম্মানিত।

যাহা হউক, কোন কথা হইতে কোন কথায় চলিয়া গিয়াছি। বলিতেছিলাম, সাজসজ্জা করিতে আমার মন আকুলি বিকুলি করে, কিন্তুক পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে হইয়া ওঠেনা, এবং আমি সেইটিকে উদাসীনতা মনে করিয়া চালাইয়া নেই। আমার আপন সহোদরা তাহার বিবাহ এবং বিবাহ পূর্ববর্তী সাজসজ্জার কিয়দংশ সহস্তে করিয়া বিভিন্ন মহলের প্রশংসা কুড়াইয়াছিল। তাহারই আপন জেষ্ঠ্যভগ্নী হইয়া আমার স্বীয় সাজবোধের প্রতি অযত্নে মাঝে সাঝে নিজকে অভক্তি করিতে মন চায়। সদাই তো কতই করিয়া থাকি। এই প্রসঙ্গে একখানা ঘটনা মনে পড়িল। একবার এক দাপ্তরিক কার্যে যুক্তরাজ্য যাইতে হইয়াছিল। এক শহরতলীতে শারলট টিল্ব্যরি’র মনোহরী পণ্য-সামগ্রীর প্রদর্শনাগার সামনে পাইয়া আমার মনে হইয়াছিল “প্রানের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি”, লালসা সংবরণ করিতে না পারিয়া কষ্টার্জিত অর্থ হইতে কতকিছু সদাই করিয়া ফেলিলাম সেইবার। মনে ভাবিলাম, ইহাকে কহে নিজের প্রতি ভালবাসা। খোদা নাম জপ করিয়া নিজকে বুঝাইলাম আপনারে ভালবাসে যে জন সৃষ্টিকে ভালবাসা কেবল উহার পক্ষেই সম্ভব। গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া কালক্রমে জীবনের জাঁতাকলে চাপ খাইয়া সেইসব মনোহরী পণ্য আর ব্যবহার করা কই হইয়া উঠিলে! সামাজিক আসরের প্রাক্কালে আমার সঞ্চিত প্রিয় সজ্জাবস্তুগুলি সদ্ব্যবহারের সুযোগইবা কোনক্ষণে মিলিলে।

বিড়ম্বনা খালি সেইটিই নহে। যদিচ সময় মিলাইতে পারি, সংখ্যাগরিষ্ট ক্ষেত্রেই পাউডার মাখিলে কখনো অনুভব হয় বদনখানা বুঝি একটু ভার ভার লাগিতেছে। লিপিশটিক লাগাইলে কথা বলিতে গিয়া অনর্থক দুর্ভোগ টের পাই। আইলাইনার, মাশকারা মাখিলে ক্ষানিক বাদে অপ্রীতিকর মস্তিষ্ক বেদনার উদয় হইয়াছে এমন ইতিহাসও আমার নিতান্ত কম নহে। কি মূল্য আছে নিজেই নিজের স্থৈর্যচ্যুতির কারন হইবার। ভোজভাতে যাইবার প্রাক্কালে, শেষটায় এইটেই ভাবিয়া ঘষিয়া ঘষিয়া মুখমণ্ডল হইতে সজ্জাস্তরন তুলিয়া হালকা করিবার ইতিহাস বহু গড়িয়াছি। কান হইতে ওজনদার দুলখানি খুলিয়া স্বল্পভার ফুলখানি পড়িয়াছি। হাত হইতে ঝকমকি বালাখানি নামাইয়া পলতোলা সাদামাটা বেলোয়ারী চাপাইবকিনা ভাবিয়াছি। সাজসজ্জা নিয়া আমার এইরূপ লালসা সমেত ভ্যাবাচ্যাকা উদাসীনতাকে কি নাম দিব অদ্যাবধি ঠাহর করিতে পারিনা। তথাপি যখন সজ্জন ও বন্ধু মহল হইতে ভালবাসা রসের ফল্গুধারায় কখনো সখনো বালাটি, দুলটি, ফুলেল হারখানি উপহার পাই, তখন নিশ্চিত প্রফুল্লতা টের পাই।

চন্দ্রবর্ণ অলঙ্কার বাক্স উপঢৌকন হিসেবে পাইবার পর মাস গড়াইয়াছে। গহনা গুছাইব গুছাইব করিয়াও সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিনাই। একদিন দেখিলাম বাক্সখানি আমার কন্যার ঝুলন-কেদারার এক পাশে পড়িয়া আছে। কবে থাকিয়া কে জানে। নিজেকে ভর্ৎসনা করিয়া বাক্স খানা পরম যত্নে তুলিয়া লইলাম। উহাকে কিছুটা ভারি বোধ হইল। পাল্লা খুলিয়া দেখি ভিতরে শোভা পাইতেছে আমার কন্যাটির যাবতীয় কলমাদি। বাক্সখানি কোনক্ষণে খুঁজিয়া লইয়া উহাকে কলম রাখিবার পাত্র হিসেবে সে ব্যবহার করিয়া আসিতেছে। কবে থাকিয়া কে জানে! মনে ভাবিলাম, থাউক, ক্রমে ক্রমে পুনরায় নিজ জিনিস নিজ করায়ত্তে আনিব। সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তুক, দিন যাইতেছে। স্নেহবৎসলতা হেতু অলঙ্কার বাক্সখানা আর নিজের করিয়া লইতে পারিতেছিনা। কন্যাটিও উহার প্রতি একরকম দাবি রপ্ত করিয়া সেইটিকে কলমগুলির পাকাপোক্ত আতুরাশ্রম বানাইয়া লইয়াছে। বাক্সখানা রহস্যময়ই বটে; কি ভাবিয়াছিলাম আর কি ঘটিল!
অগত্যা ভাবিয়া লইলাম, লেখনী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট অলঙ্কার আর কিইবা আছে; এইকথা নিজেকে বুঝাইয়া সেইবেলা ক্ষান্ত হইলাম।

জে এফ নুশান

ছবি: 
01/06/2007 - 1:46পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

করবী মালাকার এর ছবি

সত্য " লেখনী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট অলঙ্কার আর কিইবা আছে" ।

জে এফ নুশান এর ছবি

পড়ার ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, করবী মালাকার।

নুশান

এক লহমা এর ছবি

গল্প বলাটি খুব ভাল লেগেছে। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

জে এফ নুশান এর ছবি

পড়ার ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ, এক লহমা।

নুশান

সোহেল ইমাম এর ছবি

চমৎকার।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জে এফ নুশান এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, সোহেল ইমাম।

নুশান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।