পুতুলবন্দী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৭/১২/২০১৯ - ৭:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সন্ধ্যা সাতটা পেরুতেই বাসটা একরাশ ধুলো আর কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যশোর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঘেরপাড়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। বাসের নামটা এতক্ষন তারেক সাহেবের চোখে পড়েনি। ড্রাইভারের সামনে একদম সামনের আসনে বসার কারনে সামনের কাঁচের উপরে লেখা নামটা চোখে পড়ল, “বাঘেরপাড়া ভি আই পি এক্সপ্রেস”। দেখেই তিনি মনে মনে মুচকি হাসলেন। এই বুঝি ভি আই পি বাসের অবস্থা, তার উপর আবার এক্সপ্রেস! একটু পরেই এরা রাস্তায় যেখানে সেখানে লোক তোলা শুরু করবে। দীর্ঘ ২৫ বছরের চাকরী জীবনে দেশের না না আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাঁকে। এসব তিনি ঢের দেখেছেন। এদেশের মানুষ আর যাই হোক যেকোন কিছুর বুদ্ধিদীপ্ত নামকরনে উস্তাদ। পচা ডোবার উপর মাচা তৈরি করে বানানো প্রায় পড় পড় চায়ের টং দোকানের নাম দেখেছেন “স্ন্যাক্স কর্নার”। তারেক সাহেব যাচ্ছেন বাঘেরপাড়ার একটা ব্যাঙ্কের স্থানীয় ব্রাঞ্চ অডিট করতে, এই ব্রাঞ্চটা নতুন হয়েছে। তারেক সাহেব যে ব্যাংকে কাজ করেন উনি সেখানে বেশ সিনিয়র, ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের পরেই উনি, তাই চাইলেই এই ছোটাছুটির কাজগুলো জুনিয়রদের দিয়ে করানো যায়। কিন্তু চাকরীর প্রথম জীবনে অনেক ছোটাছুটি করতে করতে ব্যাপারটা তারেক সাহেবের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে মাসে একবার করে ঢাকার বাইরে আসতে না পারলে এখন তাঁর দম বন্ধ মনে হয়।তাই সবসময়ই অডিটের কাজগুলোতে নিজেই বেরিয়ে পড়েন। উনার কাছে ঘুরতে গেলেই যে সমুদ্র দেখতে কক্সবাজার কিংবা চা-বাগান দেখতে সিলেটে দৌড়োতে হবে এরকমটা নয়। উনার কাছে যেকোন নতুন জায়গা, সেখানকার নতুন কিছু মুখ, দোকানপাট সবই পর্যবেক্ষণযোগ্য এবং রীতিমত উপভোগ করার মত। আর সব জায়গারই একটা নিজস্ব গল্প থাকে, থাকে কিছু অমূল্য ঐতিহ্য। এইতো গত মাসে তিনি মানিকগঞ্জ গিয়েছিলেন অডিটের কাজে। সেখানে একবেলা সময় করে বেরিয়ে পড়েছিলেন হাজারী গুড় তৈরি দেখতে। একই গুড় শুধু বানানোর কায়দার পার্থক্যের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ! সাধারন গুড় যেখানে ১০০ টাকা কেজি হাজারী গুড় সেখানে ৮০০ টাকা, ভাবা যায়! এই গুড়ের নাম কেন হাজারী গুড় তা অনুসন্ধান করে তিনি জানতে পারলেন যে, কথিত আছে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে এই গুড় উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল আর এই গুড় এতই মলায়েম যে তিনি যখন এই গুড় স্পর্শ করেছিলেন তখন তা হাজার টুকরা হয়ে ভেঙ্গে যায়, সেই থেকে এর নাম হয় হাজারী গুড়। এমন কত গল্পই না ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে, শুধু দেখার মত চোখ থাকা চাই।

তারেক সাহেবের স্ত্রী ক্যান্সারে গত হয়েছেন ৭ বছর আগে। স্ত্রীর মৃত্যুর সময় তাঁর এক মাত্র ছেলে সেজান সবে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। নিজের প্যারেন্টিং স্কিলের উপর তারেক সাহেবের এমনিতেই খুব একটা ভরসা নেই, তার উপর আছে এই ঘুরে বেড়ানোর বাতিক। তাই স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেজানের জার্মান প্রবাসী মেজমামা যখন সেজানকে জার্মানি নিয়ে যেতে চাইল তিনি আপত্তি করেন নি। এমনিতেও খবরের কাগজ খুললেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মাদকাসক্তি আর ভুল পথে পা বাড়ানোর যেসব খবর দেখেন তা তে ছেলেটা যদি দেশের বাইরে ভালোভাবে মানুষ হয়, মন্দ কি। প্রথম প্রথম এই ভেবে তিনি মনে মনে কিছুটা অশান্তিতে ছিলেন যে ছেলেটার মা মারা গেছে, এখন বাবার স্নেহ থেকেও তিনি ছেলেটাকে বঞ্চিত করছেন। পরে ভেবেছেন এই বয়সে মা-হারা হওয়ার চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কি হতে পারে মানুষের জীবনে! সেজান যখন সেটাই সামলে নিয়েছে, ছেলেটা শক্ত হয়েই বড় হোক। শেষমেশ সেজান ভালোই করেছে, জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুটে গোথে ইউনিভার্সিটি থেকে আই টি তে স্নাতক শেষ করে ছয় মাস হয় একটা চাকরীতে ঢুকেছে। গত ৭ বছরে তারেক সাহেব তিন বার ছেলেকে দেখেও এসেছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেন না। এর একটা কারণ বোধহয় তাঁর এই বাউন্ডুলে স্বভাব, ঘরে ফেরার তাড়া নেই, যেখানে খুশি চলে যাও, মন্দ কি? এই বেশ ভালো আছেন তিনি।

তারেক সাহেব আজকে সকালের ট্রেনে ঢাকা থেকে যশোর রওনা হয়েছিলেন। বিকালেই যশোর পৌঁছানোর কথা, সন্ধ্যার মাঝে বাঘেরপাড়া। কিন্তু ট্রেন কমলাপুর থেকে ছাড়তেই পাক্কা তিন ঘন্টা দেরি করেছে। তাই যশোর পৌঁছুতেই হয়ে গেছে সন্ধ্যা।অবশ্য স্টেশনে, বাসে কিংবা ট্রেনে সময় কাটানো তাঁর জন্য কোন ব্যাপার না। তিনি মনে মনে কিছু ছেলেমানুষি খেলা খেলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারেন। এর একটা হল গন্ধের খেলা, আরেকটা শব্দের খেলা। তাঁর স্ত্রীর বই পড়ার নেশা ছিল, তাই ভ্রমনে গেলে সে বাসে কিংবা ট্রেনে সবসময় বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতেন। তারেক সাহেব ছোট্ট সেজানের সাথে এই খেলাগুলো খেলতেন। দুইটা খেলার নিয়ম একইরকম। যেমন চোখ বন্ধ করে শুধু আশেপাশের শব্দ শোনার চেষ্টা করতে হবে। চোখ খোলা রেখে আশেপাশের সব শব্দ ঠিক অনুধাবন করা যায়না। কিন্তু চোখ বুঝলেই শব্দের জগত সুক্ষাতিসুক্ষ ডিটেইল নিয়ে কানে ধরা দেয়। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ, যাত্রীদের গল্প করার শব্দ, বাতসের শনশন শব্দ, বেয়ারার চায়ের কাপ নিয়ে যাওয়ার টুংটাং শব্দ, সব আলাদা আলাদা করে বুঝতে পারা যায়। একইভাবে বিভিন্ন কিছুর আলাদা আলাদা গন্ধও নাকে আসে। যেমন কেউ দরজার কাছে গিয়ে ধূমপান করছে সেই গন্ধ, সামনের আসনে বসা কেউ হয়ত চিকেন কাটলেট আর চা খাচ্ছে সেই গন্ধ, এসব আর কি। খেলার দ্বিতীয় পর্যায়ে যেই শব্দটা কানে আসল কিংবা গন্ধটা নাকে আসলো তার উৎস খুঁজতে হবে আর সেটা আসলেই ধারনার সাথে মিলেছে কিনা তা অনুসন্ধান করে মিলিয়ে দেখতে হবে। আজ সেজান তাঁর কাছে নেই, কিন্তু তিনি ভ্রমনে গেলেই এই খেলাগুলো খেলেন। যেমন এই বাঘেরপাড়ার বাসে উঠে তিনি চোখ বন্ধ করে গন্ধের খেলাটা খেলছেন। কিছুক্ষন ধরে লিচুর হালকা গন্ধ তাঁর নাকে আসছে, শীতকালে লিচু! আশ্চর্য তো ! পরে বোঝা গেল পিছনের সীটে এক বাচ্চা প্লাস্টিকের বাটিতে বন্দী লিচুর জেলি খাচ্ছে। লিচু না ছাই; আসল লিচুর বালাই নেই, শুধু ক্যামিকেলের লিচু লিচু গন্ধে মাখানো জেলি। এর মিনিট দশেক পর তাঁর নাকে এমন একটা গন্ধ এল যে তিনি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। কেমন পুরোনো কাপড়, চাপা পড়া ধুলো আর পোড়া কেরোসিন মেশানো একটা গন্ধ। বাসের তেল চিটচিটে সীট থেকে আসছে কি? হতেও পারে, এরা বাস রাস্তায় নামানোর পর কখনও সীটের কাভার ধোয় বলে তো মনে হয়না। কিন্তু গন্ধের উৎস সম্পর্কে তিনি ঠিক নিশ্চিত হতে পারছেননা। তারেক সাহেব কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন এবং অস্বস্তিটা ক্রমশ বাড়ছে। গন্ধটা কোথা থেকে আসছে খুঁজে না পেয়ে একসময় তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসের একটা ঝাপটা তাঁর পাশের জানালা দিয়ে বাসে ঢুকে গেল, গন্ধটা আর নাকে আসছেনা, অস্বস্তি ভাবটাও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে, তিনি জানলাটা বন্ধ করে দিলেন।

বাঘেরপাড়া গিয়ে তিনি উঠবেন স্থানীয় এক ডাক বাংলোয়। মফঃস্বলের ছোট হোটেল রুমে তিনি হাপিয়ে ওঠেন, তাই ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে দিয়ে জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করিয়ে তিনি এই ডাকবাংলোটা বুক করেছেন। বাংলোর কেয়ারটেকার তারানাথ বাবুকে তিনি দুপুরে ফোন করে ট্রেনের দেরি হওয়ার কথাটা জানিয়েছেন। সে বলেছে “ আপনি আসেন স্যার, আমি জাইগে থাকবো, রাত বেশি হলিও সমস্যা না ।” বাঘেরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যখন তিনি বাস থেকে নামলেন, তখন রাত পৌনে দশটা। শীতের দিনে মফঃস্বল এলাকায় যেমন ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে, তেমনি রাত বাড়ার সাথে সাথে ঘন কুয়াশার রহস্যময় চাদর আর গাছপালা রাতের আঁধারকে যেন আরও আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ঘনীভূত করে তোলে। বাসস্ট্যান্ড ইতোমধ্যে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। তিন-চারজন রিকশাওয়ালাকে দেখা গেল খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। ডাকবাংলো যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে কেউই রাজী হলনা। শীতের রাতে আগুনের উষ্ণতায় বসে গল্প করার লোভ সংবরণ করে কে ই বা চায় অন্ধকার কুয়াশা ছিঁড়ে রিকশা টানতে! ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে তারেক সাহেব মরিয়া হয়ে উঠলেন, তার উপর মশারা জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলছে। অতঃপর তাঁকে নামিয়ে দিয়ে ফাঁকা ফিরে আস্তে হবে এই বহুল প্রচলিত অজুহাতটা দেখিয়ে, স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়ায় একজন মাঝবয়সী রিকশা চালক তাঁকে ডাকবাংলো নিয়ে যেতে রাজী হল। তিনি আর দামাদামি করার ধারে কাছেও গেলেন না, বাব্বাহ; নিয়ে যাচ্ছে এইতো বেশি।

বাসস্ট্যান্ডের আলো ছেড়ে তারেক সাহেব সমেত রিকশাটা কুয়াশার রাজ্যে হারিয়ে যেতেই অন্ধকার আর ঝি ঝি পোকার রাজ্য। ঝি ঝি পোকার শব্দ ছাড়া আরেকটা শব্দ তাঁর কাছে খুব বিরক্তিকর হয়ে উঠল, রিকশার চেইন আর প্যাডেল থেকে ভেসে আসছে ক্যাচক্যাচ আওয়াজ। তিনি অভিযোগ করার আগেই রিকশাওয়ালা কাকে যেন গালাগালি করতে লাগল, সম্ভবত রিকশার মেকানিক গোছের কাউকে, তাকে নাকি সে সকালে বলেছিল প্যাডেলের স্ক্রুগুলিতে তেল দিয়ে দিতে, সে দেয়নি। মিনিট পাঁচেক এভাবে চলার পর, হঠাৎ সেই পুরনো কাপড়ের গন্ধটা তারেক সাহেবের নাকে আসল, গন্ধটায় কেমন যেন সরিষার তেলের মত একটা ঝাঁঝালো ব্যাপার আছে। তিনি আবার অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। গন্ধটা পথের ধারের গাছপালা কিংবা ভেজা মাটি থেকে আসছে কি? না, না তা কি করে হয়, গন্ধটাতো তিনি বাসেও পেয়েছেন! অদ্ভুত মুশকিলে পড়া গেল। রিকশাওয়ালাও গন্ধটা পাচ্ছে কি না সেটা তাকে জিগ্যেস করাতে সে অস্ফুট স্বরে কি একটা বলল ঠিক বোঝা গেলনা। তিনি ধরে নিলেন যে রিকশাওয়ালা বলেছে সে কোন গন্ধ পায়নি। রিকশাওয়ালাদের নিয়ে এই আরেক জ্বালা, মাঝে মাঝে সামনের দিকে মুখ করে রিকশা টানতে টানতে জীবনের পুরো ইতিহাস বলতে থাকে, এই খেয়ালও থাকেনা যে যাকে বলছে সে আদৌ কিছু শুনতে পাচ্ছে কিনা!অস্বস্তি ভাবটা ক্রমশ বাড়ছে, তারেক সাহেব উশখুশ করতে লাগলেন। হঠাৎ কোন একটা গাছের ডাল থেকে ঘুমন্ত কোন পাখি ডানা ঝাপটে উঠল।তারেক সাহেব চমকে উঠলেন। চমকে ওঠার সাথে সাথে অস্বস্তি ভাবটাও কমতে শুরু করল, সাথে সাথে গন্ধটাও কড়া থেকে আস্তে আস্তে মৃদু হতে হতে মিলিয়ে গেল।

রাত দশটা পঁচিশ, তারেক সাহেবের রিকশা ডাকবাংলোর উঠোনে এসে থেমেছে। মধ্যবয়স্ক কেয়ারটেকার তারানাথ বারান্দা থেকে দৌড়ে এসেছে সাহেবের ব্যাগ ভেতরে নিয়ে যেতে। তারানাথ স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে কেরানীর চাকরি করেন। শুধু কেয়ারটেকার এর কাজ করে তার পোষায় না। কারন এই পুরনো ডাকবাংলোয় বড় একটা কেউ আসেনা। বছর খানেক আগে পাগলাটে ছোকরা মত এক ছেলে বাংলাদেশের পুরনো স্থাপত্য নিয়ে কি একটা গবেষণা কাজে এই ডাক বাংলোতে এসে তিনদিন ছিল। চোখে ভারী চশমা, পরনে পায়জামা আর হলুদ পাঞ্জাবি, চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। চারদিনের দিন সকালে টিফিন ক্যারিয়ারে করে নাশতা নিয়ে এসে তারানাথ দেখেছে ছোকরা লাপাত্তা! এমনকি নিজের জিনিসপত্রও নিয়ে যায়নি! ছোকরা এমনিতেও উদ্ভ্রান্ত স্বভাবের, তার উপর গবেষক; তারানাথ আর ব্যাপারটা গায়ে মাখেনি। তারানাথের এক দূরসম্পর্কের মামা সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকতে থাকতে একসময় তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয় এবং চৈত্রের এক গ্রীষ্মের রাতে ঘর ছেড়ে কোথায় যে চলে যায়, আর ফেরেনা। তাই সেই গবেষক ছোকরার হঠাৎ অন্তর্ধানে তারানাথ বিচলিত হয়নি। উল্টো ভাগ্যিস সে ছোকরার কাছ থেকে পুরো সাতদিনের ভাড়া আগাম রেখে দিয়েছিল, নাহলে পুরোই লস প্রজেক্ট হত; এই ভেবে নিজেকে মনে মনে বাহবা দিয়েছে। আজ অনেকদিন পর তারেক সাহেবের দেখা পেয়ে তারানাথ মনে মনে আনন্দিত।আর কিছু না হোক, ঢাকা থেকে আসা মানুষের সাথে গল্প করতেও তার ভালো লাগে। এমনিতে স্কুলে সারাদিন শিক্ষকদের ফুট-ফরমায়েশ খেটে আর বকাঝকা শুনে তার দিন যায়। বেশি পড়াশোনা করেনি বলে কেউ তাকে গল্প করার যোগ্য মনে করেনা বোধহয়। তা তে তার তেমন দুঃখও নেই, বেশি পড়াশুনা করার ফল যে কি হয় তা তো ছেলেবেলায় পাগল মামা কে দেখেই বুঝেছে!

তারেক সাহেব যেমন ভেবেছিলেন ডাকবাংলোটা তার বিন্দুমাত্র ব্যাতিক্রম নয়, এই প্যাটার্ন টা তাঁর চেনা। লাল দালান, বড় একটা বসার ঘর তার একপাশে টেবিল বিছিয়ে খাবার ব্যবস্থা। ভেতরে তিনটা বড় বড় কামরা। মোটা মোটা দেয়াল আর কাঠের পাল্লা দেয়া বড় বড় সবুজ জানালা। ডাকবাংলো জুড়ে ভারী ভারী সেকেলে কাঠের আসবাব, একদম লাইফ গ্যারান্টি বলতে যা বোঝায় আরকি; কুড়োল দিয়ে কাটতে গেলেও বোধ করি গলদঘর্ম হতে হবে! তিনি কাপড় ছেড়ে, হাত মুখ ধুয়ে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে নিলেন। শেষবার যখন তিনি ছেলেকে দেখতে জার্মানি গিয়েছিলেন, এই টি-শার্টটা সেজান শখ করে তাঁকে কিনে দিয়েছিল। সবুজ টিশার্টের মাঝে হলুদ রঙ্গে লেখা “কুলেস্ট ড্যাড ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”। ভালোই জাঁকিয়ে শীত পড়ছে, শুধু টি শার্টে হবেনা। তিনি টিশার্টের উপর একটা চাদর চাপিয়ে নিলেন। সারাদিনের জার্নির ধকলে এখন কেমন নিস্তেজ লাগছে। গরমের দিন হলে গোসল করা যেত, সেক্ষেত্রে ভ্রমণজনিত ক্লান্তি পুরোপুরি দূর হয়ে যেত। কিন্তু এই শীতে সেই ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবেনা, জ্বর-টর আসলে হবে আরেক যন্ত্রনা, কালকে সকাল থেকেই তাঁকে কাজে নেমে পড়তে হবে। এখন কিছু একটা মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারলেই বাঁচা যায়।

খাবারের টেবিলে বসে তিনি বেশ চমৎকৃত হলেন। ধোঁয়া ওঠা মুরগীর মাংশের ঝোল, ডিম পোচ, আলু ভাজি আর হাতে বানানো আটার রুটি। এতটা তিনি আশা করেন নি। খাবার তারানাথ টিফিন ক্যারিয়ারে করে বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। তিনি যখন হাত মুখ ধুচ্ছিলেন তখন স্টোভ জ্বালিয়ে মাংশ গরম করেছে। বাহ, লোকটা বেশ গোছানো তো! আশেপাশে অগোছালো লোক দেখতে দেখতে তিনি ক্লান্ত। এই যেমন যেই অডিটের কাজে তিনি এসেছেন সব গোছানো থাকলে তা দুই দিনের মাঝেই শেষ করা সম্ভব, কিন্তু দুই দিনের জায়গায় লাগবে পাঁচদিন। তিনি আরও সাত দিন আগে ঢাকা থেকে এখানকার ব্রাঞ্চ অফিসে ফোন করে বলে রেখেছেন কি কি প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র গুছিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু তিনি নিশ্চিত কাল গিয়ে দেখবেন কিছুই ঠিক জায়গায় নেই। এই ঘটনা আগেও ঘটেছে। এরকম না যে কাগজপত্রে কোন গন্ডগোল আছে বলে তারা গোপন করতে চায়, স্রেফ গাফেলতি করেই এরা কিছু ঠিকঠাক রাখেনা। তিনি তারানাথকে বল্লেনঃ “ তারানাথ, তুমিও খেয়ে নাও, রাত তো অনেক হল। ” তারানাথ বলল “আমি বাড়ি থেকে খেয়ে আসিছি স্যার, আপনি খান, স্যারের রাস্তায় কোন সমস্যা হয় নাই তো” তারেক সাহেব খানিক্টা মুরগীর ঝোল প্লেটে তুলে নিয়ে বললেন “ না, ট্রেন লেইট হওয়া ছাড়া আর কোন সমস্যা হয়নি, শুধু তোমাদের বাসস্ট্যান্ড থেকে ডাকবাংলোতে আসতে রিকশা পাওয়া যাচ্ছিল না।” রান্না বেশ সুস্বাদু, ঝাল একটু বেশি, তারেক সাহেব এত ঝাল খান না, কিন্তু এই শীতের রাতে ঝাল ঝাল মাংশই বেশ লাগছে। তারেক সাহেব পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঝাল সংবরণ করতে করতে বললেন “রান্নাতো বেশ হয়েছে, তুমি রেঁধেছ নাকি?” তারানাথ লাজুক ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল “জী না স্যার আমার বউ রাধিছে।” এরপর তারেক সাহেব যতক্ষন খেলেন ততক্ষন তারানাথ তার বউ আর কি কি খাবার ভালো রাঁধে, এখন শীতকাল না হয়ে বর্ষাকাল হলে তাঁকে সে ইলিশের পাতুরি খাওয়াতে পারত, তার বউ এর রাধা ইলিশের পাতুরি একবার খেলে তারেক সাহেব সারাজীবনে ভুলতে পারবেননা ইত্যাদি বকে যেতে লাগল। তারেক সাহেব শুধু হু হা করে যেতে যেতে মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। এই বস্তুকে লাই দেয়া যাবেনা, এমনিতেই সারাদিন অডিটের কাজে বকর বকর করতে হবে, একে লাই দিলে সে সন্ধ্যার পর থেকে এসে কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে ফেলবে।

খাওয়া হয়ে গেলে তারেক সাহেব টেবিল থেকে উঠে সোফায় বসলেন। তারানাথ বলল “স্যার কি চা খাবেন?” তারেক সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন “ না হে তারানাথ, আমি বরং শুয়ে পড়ি, ঘুম পাচ্ছে খুব, সকাল সকাল উঠতে হবে, এই অসময়ে চা খেলে ঘুমটা চটে যেতে পারে।” তারানাথ টিফিন ক্যারিয়ারটা গুছিয়ে নিতে নিতে বলল “তাহলে স্যার আপনি দরজা দিয়ে শুইয়ে পড়েন, আমি সকালে নাস্তা নিয়ে আসবো।” তারেক সাহেব বললেন, “না, না তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবেনা, আমি ভোরে বেরিয়ে যাব, অফিসের আশেপাশে কোন হোটেলে নাস্তা করে নেব।”

তারানাথ চলে গেলে তারেক সাহেব সদর দরজা লাগিয়ে শোবার ঘরে এসে পুরোনো একটা বেতের ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। এই ঘরটায় আসবাব বলতে একটা খাট, একটা দেয়ালজোড়া কাঠের আলমারি আর এই বেতের ডিভান টা। বিছানায় সাদা চাদর আর পায়ের কাছে পরিষ্কার লেপ ভাঁজ করা আছে।নাহ, তারানাথ কথা বেশি বললেও করিৎকর্মা লোক। তারেক সাহেব তাকে থাকা খাওয়ার খরচের বাইরেও একটা ভালো অংকের বকশিশ দেবেন বলে ঠিক করলেন। একটা বিষয় দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। ডাকবাংলোর ভেতর কোন মশা নেই। আশ্চর্য তো! চারিদিকে যেমন ঝোপঝাড় মশার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকার কথা, তার উপর আবার শীতকাল। আসলেই কি ভাববার মত ব্যাপার? হয়ত এমনিতেই কোন প্রাকৃতিক কারনে এই এলাকায় মশার প্রকোপ কম। কিন্তু তাও বা কি করে হয়, বাস স্ট্যান্ডেও তো মশার জ্বালায় দুদণ্ডও দাড়ানো যাচ্ছিল না। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হল এই ডাকবাংলোতে ঢোকার পর থেকে তিনি একবারও ঝি ঝি পোকার ডাক শোনেন নি। এতক্ষন ফ্রেশ হওয়া, খাওয়া-দাওয়া আর তারানাথের সাথে গল্প করা এসব নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন এবং সবসময়ই অন্যকোন শব্দ আশেপাশে ছিল বলে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নি। এখন সবকিছু নিরব হয়ে যাওয়াতে ব্যাপারটা লক্ষ করছেন। কেমন আশ্চর্য নীরব চারপাশ, যেন নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছেনা।তারেক সাহেব লক্ষ্য করেছেন যে সব বাড়ির একটা নিজস্ব প্রান থাকে, এই ডাকবাংলোটা কেমন প্রানহীন; মৃতের মত নিঃসাড়! আচ্ছা, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ কি প্রানহীন বাড়ি চিনতে পারে? যেটা মানুষ পারেনা…হয়ত এইজন্যই মশা নেই, কিংবা আশেপাশে ঝি ঝি পোকাও নেই। কে জানে! পশুপাখিরা নাকি যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগে থেকে টের পায়, অমন কোনকিছু টের পেয়ে সব ভেগেছে নাকি? রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশ শীত বাড়ছে। তারেক সাহেব ঘড়ি দেখলেন, পৌনে বারোটা। লেপের নিচে ঢুকে পরা দরকার। তারেক সাহেব চাদরটা ডিভানে খুলে রেখে, বাতি নিভিয়ে খাটে উঠে গেলেন। মশা না থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে মশারী খাটাতে হবেনা, মশারী খাটালে তাঁর দম বন্ধ বন্ধ লাগে। তারেক সাহেব তাঁর ঢাকার বাসায়ও এরোসোল স্প্রে করে ঘুমান, মশারী খাটান না। ফলশ্রুতিতে গত বছর ভয়াবহ ডেঙ্গুতে পড়েছিলেন, অবশেষে ৭ দিন হাসপাতাল বাস।

নতুন জায়গায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসবে এই দুরাশা তারেক সাহেবের কস্মিনকালেও নেই। না না বিচিত্র চিন্তা তাঁর মন কে ঘিরে ধরল, যেমন এই ডাকবাংলোটা কত বছরের পুরোনো? জমিদার আমলের বলে মনে হচ্ছেনা, তবে অন্তত ইংরেজ আমলের হবেই, তা-ও দেড়শ বছর হবে। তারেক সাহেব পাঁচ বছর আগে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে সেটাতে থাকা শুরু করেছিলেন, দুই বছরের মাথায় বাথরুমের শাওয়ারের লাইন থেকে দেয়ালের ভেতর পানি লিক হয়ে বেডরুমের দেয়াল ফুলে ঢোল হয়েছে, বারন্দার গ্রিলে জং ধরেছে, মেঝের কয়েক জায়গায় টাইলসে ফাটল ধরেছে। আচ্ছা, এরা সেই আমলে কিভাবে এমন মজবুত গাঁথুনি দিয়ে দালানকোঠা বানাতো যে এমন যুগের পর যুগ সংস্কারবিহীন অবস্থায় দিব্যি টিকে থাকে? উত্তরটা তারেক সাহেবের জানা নেই, দালানকোঠা সম্পর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র কোন ধারণা নেই।ব্যাংকের হিসাব মেলানো ছাড়া তিনি কি আর কিছু আদৌ জানেন......... তারেক সাহেব কখন ঘুমে তলিয়ে গেলেন বুঝতেও পারলেন না।

মাঝরাতে হঠাৎ খুটখুট শব্দে তারেক সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেল, ঠিক কতক্ষন ঘুমিয়েছেন তিনি তা ঠাহর করতে পারলেন না। মোবাইলের আলোতে দেখলেন রাত দুইটা পয়ত্রিশ। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াটা উনার জীবনে বিরল ঘটনা, একবার ঘুমালে উনার ঘুম সকালের আগে ভাঙ্গেনা। খুট খুট শব্দটা থেমে গেছে। যাক তাহলে ইঁদুর টিদুর কিছু একটা আছে বোধহয়, নাহলে শব্দ করবে কি। মশা না থাকার কারনে তিনি যে ডাকবাংলোর প্রানহীনতা আর সে বিষয়ে কীট পতঙ্গের সিক্সথ সেন্স সংক্রান্ত জটিল তত্ত্ব ফেঁদে বসেছিলেন তা ভেবে মনে মনে হাসলেন। খুট খুট শব্দটা আবার হচ্ছে, এবার শুধু শব্দ না মনে হচ্ছে ফিস ফিস করে কে কথা বলছে। কথা গুলো খুব ক্ষীণস্বরে, শব্দ আলাদা করা যাচ্ছেনা, কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের পথশ্রমে তাঁর হেলুসিনেশান হচ্ছে কি? শব্দটা এবার আরও জোরালো হয়েছে এবং কেমন ধস্তাধস্তির মত শব্দ হচ্ছে। শব্দটা আসছে দেয়ালের আলমারিটার ভেতর থেকে। তিনি আবছা আধারে লক্ষ করলেন আলমারির পাল্লাটা মৃদু কাঁপছে। তারেক সাহেব সবচেয়ে বেশি ভয় পেলেন যখন তিনি লক্ষ করলেন ঐ অস্বস্তিকর পুরোনো চাপা পড়া কাপড় আর কেরোসিন মেশানো গন্ধটা ফিরে এসেছে। তিনি তড়াক করে উঠে আলো জ্বাললেন। কোন খুটখাট শব্দ নেই, ফিসফিস কথাও থেমে গেছে, আলমারির পাল্লাও স্থির। গন্ধটা এখনও আছে কিন্তু মৃদু, আস্তে আস্তে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি নিশ্চিত হলেন যে পুরো ব্যাপারটাই উনার মস্তিষ্কের ভেতরে হচ্ছে। তবুও মানসিক শান্তির জন্য তিনি আলমারিটা খুললেন। বামপাশে কাপড় ঝোলানোর জায়গাটা ফাঁকা, ডানদিকে দুইটা ড্রয়ার, প্রথম ড্রয়ারটাতে কিছু পুরাতন ছেঁড়া পেপার আর ময়লা কালিমাখা কাপড়। কাপড়টাতে সম্ভবত হ্যারিকেনের কালি লেগেছে। পরের ড্রয়ারটা খুলতেই সেই তীব্র চাপা পড়া পুরোনো গন্ধটা ভক করে বেরিয়ে এসে তাঁর মগজটাকে একদম নাড়িয়ে দিল। তারেক সাহেব ড্রয়ারটাতে তিনটা পুতুল আবিষ্কার করলেন। পুতুলগুলো আকৃতিতে সাধারন পুতুলের মতই, চার পাঁচ আঙ্গুল লম্বা হবে। কিন্তু সেগুলো গতানুগতিক বাচ্চাদের খেলনা পুতুলের মত নয়, কেমন যেন মনে হল পুতুলগুলো কোন জীবন্ত মানুষের প্রতিকৃতি। যেন জ্যান্ত কোন মানুষকে অনুকরণ করে বানানো হয়েছে, মুখগুলো কেমন একটু ফোলাফোলা, কিন্তু জামাকাপড় একদম সত্যিকারের জামাকাপড়ের মত। যেন কোন উঁচু দরের শিল্পীর বানানো, যেনতেন কোন পুতুল কারিগরের বানানো নয়।

প্রথম পুতুলটা একটা স্লিপিং গাউন পরা, কোঁকরানো চুল, মুখের আকৃতি দেখে ইউরোপিয়ান সাহেব বলেই মনে হয়। দ্বিতীয় পুতুলটা ধুতি পরা, খালি গা, গায়ে পৈতেও আছে। আশ্চর্য! এমন অদ্ভুত পুতুল তো তিনি কখনও দেখেন নি। তৃতীয় পুতুলটা একটা কম বয়সি ছেলের, চোখে ভারী চশমা পরনে হলুদ পাঞ্জাবী আর পাজামা। তারেক সাহেব পুতুলগুলো হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সবগুলো পুতুলের ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত বিষয়ে মিল লক্ষণীয়, সবগুলো পুতুলকেই শুতে যাওয়ার সময় মানুষ যেমন ঢিলেঢালা কাপড় পরে তেমন জামা পরানো হয়েছে, এর মানে কি! তারেক সাহেব এই শীতের মাঝেও উত্তেজনায় ঘামতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর সাথে একটা ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তিনি কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। তারানাথকে ফোন করবেন কি?এত রাতে কি তাকে পাওয়া যাবে?এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে যেন তাঁর হাতের পুতুলগুলো নড়ে উঠল, তিনি চমকে উঠে সেগুলো ড্রয়ারের ভেতর ছুঁড়ে ফেললেন। ঠিক সেসময় ঘরের একমাত্র বৈদ্যুতিক বাতিটা নিভু নিভু হতে হতে নিভেই গেল। তিনি গাঢ় নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেলেন, আঁধারে হাতড়ে হাতড়ে বাতির সুইচটা খুঁজতে লাগলেন কিন্তু খুঁজে পেলেন না। এক অজানা ভয়ে তিনি থরথর করে কাঁপছেন। পুরো ঘরটাই এখন সেই পুরনো গন্ধটাতে পরিপূর্ণ। অন্ধকার যখন তারেক সাহেবের চোখে সয়ে এল তিনি আবছা আবছা দেখলেন খোলা আলমারির ভেতর থেকে শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস ঘরের মাঝে ঢুকে পড়ছে, আর সেই বাতাসের সাথে জমাট বাঁধা একটা অন্ধকার ধোঁয়ার মত কুন্ডুলি পাকিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। যেন আলমারিটা একটা খোলা জানালা, আর জানালার ওপাশে অন্যকোন ভূবন, যে জগতের সাথে এই চেনা জগতের কোন মিল নেই। তারেক সাহেব হতবাক হয়ে লক্ষ করলেন কুন্ডুলি পাকানো অন্ধকারটা তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে এবং কিছুক্ষনের মাঝেই তাঁকে ঘিরে ধরে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলছে। প্রচন্ড বাতাস তাঁকে শুন্যে তুলে চোখের পলকে আলমারির অন্ধকার গহবরে টেনে নিয়ে গেল। তারেক সাহেব অনুভব করলেন যে তাঁর শরীর ধীরে ধীরে কেমন হালকা হয়ে যাচ্ছে, কে যেন তাঁর শরীরের সব রক্ত শুষে নিচ্ছে আর তিনি এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যেন অনন্তকাল ধরে ঐ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছেন, কিন্তু ঠাই পাচ্ছেন না।

এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পর বাঘেরপাড়া থানার সাব ইনস্পেক্টর নিজামুদ্দিন ডাকবাংলোটাতে আসলেন তারেক সাহেব নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা তদন্ত করতে। নেহায়েত স্থানীয় ব্যাংক থেকে একজন কর্মকর্তা এসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে বলে তাঁকে আসতে হয়েছে।তিনি এসেছেন স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করতে। থানায় খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজির এত এত ফাইল পড়ে আছে, এসব নিখোঁজ সংবাদ তাড়া করে ফিরলে তাঁর চলেনা। কিন্তু অভিযোগের ফাইলে প্রাথমিক তদন্ত করে কিছু লিখতে হয় তাই আসা, ওপেন এন্ড শাট কেইস।ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার তারানাথকে জিজ্ঞেস করে তেমন কিছু জানা গেলনা। শুধু জানলেন তারেক সাহেব এই ডাকবাংলোতে এক রাত ছিলেন, পরের দিন হয়তো তিনি বাংলো থেকে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসেন নি, ব্যাস এইটুকুই। ডাকবাংলো সার্চ করে বিশেষ আর কিছু পাওয়া গেলনা। আলমারির ভেতরে নিজামুদ্দিন চারটা পুরনো ময়লা পুতুল দেখতে পেলেন, এত নিখুঁত পুতুল যে এই দেশে তৈরি নয় তা তিনি বুঝতে পারলেন, কে রেখে গেছে কে জানে! ইংরেজ আমলের পুরনো ডাকবাংলো, কোন ইংরেজ সাহেবের বাচ্চার পুতুল হবে হয়ত। তিনি ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিলেন।নিজামুদ্দিন যেই চারটা পুতুল দেখেছিলেন তার মাঝে প্রথম তিনটা পুতুলের বর্ণনা আগেই তারেক সাহেবের জবানিতে দেয়া হয়েছে। চতুর্থটা একজন পঞ্চাশোর্ধ মানুষের, পুতুলটার গায়ে পরনে ছিল একটা সবুজ টি শার্ট। নিজামুদ্দিন যদি ভালো করে লক্ষ্য করতেন তাহলে ঠিক পড়তে পারতেন যে টিশার্টের বুকে সুক্ষ হলুদ সুতায় ছোট ছোট করে লেখা আছে “কুলেস্ট ড্যাড ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”।


মন্তব্য

Emran  এর ছবি

চমৎকার গল্প! পড়ে মনে হল কিছুটা এম আর জেমস-এর ছায়া আছে। আরও লিখুন। আর দয়া করে নিজের নামটা উল্লেখ করবেন।

এই গল্পটা (এবং বাংলায় এই ধরণের গল্প আরও লেখা হয়েছে) নিয়ে কিন্তু দারুণ একটা ৮০-৯০ মিনিটের ছবি হয়ে যেতে পারে!

সৌখিন  এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। আমার নামটা ক্যাটেগরিতে আছে। এম আর জেমস এর গল্প কখনো পড়া হয়নি, সুযোগ হলে পড়ব।

সত্যপীর এর ছবি

এরকম গল্প আজকাল তেমন দেখিনা। খুব চমৎকার লাগল।

..................................................................
#Banshibir.

সৌখিন  এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পের ঘনঘটা যেভাবে আগাচ্ছিল তাতে গল্পের দৈর্ঘ্য আরও বেশি হবে বলে মেনে করেছিলাম। বর্ণনার খুঁটিনাটি নিখুঁত এবং পাঠককে টেনে রাখার মতো। শেষ পর্যন্ত কাহিনীটা যদিও সুজয় ঘোষের স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র 'অহল্যা' আর সত্যজিত রায়ের ছোটগল্প 'প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল'-এর মতো হয়ে গেছে কিন্তু এই গল্পটা নিজ বৈশিষ্ট্যে আলাদা।

গল্প চলুক। লেখকের নাম শুধু ট্যাগে থাকলে চলবে না, গল্পের নিচেও থাকতে হবে।

ফলশ্রুতি = শ্রুতিতে যে ফল লাভ হয়। যেমন, বেদ শ্রবন করলে ফল লাভ হয়।
ফলে = পরিণতিতে। যেমন, মশার কামড়ের ফলে তারেক সাহেব ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তিথীডোর এর ছবি

পড়তে পড়তে অহল্যা 'র কথাই মনে পড়ছিলো।

চমৎকার হয়েছে লেখাটা। চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সৌখিন  এর ছবি

অহল্যা দেখা হয়নি। পরামরশগুলোর জন্য ধন্যবাদ। পরবর্তী লেখায় কাজে লাগবে।

মন মাঝি এর ছবি

সেবা প্রকাশণী প্রকাশিত কাজী আনোয়ার হোসেনের "আজব" সিরিজের (পঞ্চ রোমাঞ্চ, ছয় রোমাঞ্চ, ছায়া অরন্য,ইত্যাদি) কোনো বইতে বোধহয় এরকম একটা গল্প ছিল?

****************************************

সৌখিন  এর ছবি

আমার লেখার সাথে কতটা কাকতালীয় মিল আছে পড়ে দেখতে চাই। সময় পেলে খুঁজে বলবেন

এক লহমা এর ছবি

গল্পের বুনট সুন্দর।
গল্পের পরিণতি পরিচিত।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সৌখিন  এর ছবি

পড়ার জন‌্য ধন্যবাদ

সোহেল ইমাম এর ছবি

বাহ !! চমৎকার। অতিপ্রাকৃত গল্প পড়াই হয়না।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সৌখিন  এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।