ভেলোসিরেপ্টর (ডাইনোসর-গণবিশেষ) উষ্ণরক্তবাহী ছিল? জীবাশ্ম প্রোটিন থেকে ডাইনোসর-রহস্য উদঘাটন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৭/১১/২০২০ - ৫:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

টাইরানোসরাস রেক্স এর দাঁতের উপর রমন স্পেক্টোমিটারের লেজার প্রতিফলিত হচ্ছে, দাঁতের অভ্যন্তরে অপ্রকাশিত জৈবিকপদার্থের তথ্যসংগ্রহকালীন সময়ের ছবি। (ছবিঃ লিন্ডসে লিগার)

লেখাঃ গ্রেশেন ভোগেল, অক্টোবর ৮, ২০১৯, রাত ১০ঃ১৫।
অনুবাদ: আইভি সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রাকৃতিক ইতিহাসের পিবডি জাদুঘরে জেসমিনা ওয়েম্যান টেনে খুললেন মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত লম্বা একটি নমুনা সংরক্ষনের ড্রয়ার। তিনি উঁচিয়ে দেখালেন ভয়ঙ্কর ধারালো,কয়লা-কালো, কাস্তে-আকৃতির একটি ডাইনোসরের থাবা। বললেন তিনি- “জুরাসিক পার্ক” সিনেমায় ভেলোসিরাপ্টরের আদল, এই ধরনের ডাইনোনিশাসের নমুনা থেকেই নেওয়া হয়েছে। কালো রঙটি এখানে কিছু চমকপ্রদ কথা বলছে। এই জীবাশ্মটি কেবল একটি খনিজ প্রতিকৃতি নয়। এখানে ডাইনোসরের দুই - তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট পদার্থ রয়েছে। ওয়েম্যান আরো বলেন, “আমি ধারণা করি, নমুনাটিতে আয়তনের প্রায় ৭০% জৈবিক পদার্থ থাকবে - যা আমাদের কল্পনার থেকেও বেশী।

জীবাশ্মটিতে জৈবিক পদার্থ থাকবে- এ ধারণা নতুন নয়। বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রেই প্রাগৈতিহাসিক ডিএনএ ও অক্ষত প্রোটিনের রহস্য-উদঘাটন ব্যাপারটি প্রচলিত আছে। তবে বেশিরভাগ গবেষকেরা মনে করেন, ডাইনোনিশাসের থাবার মত পুরনো জীবাশ্ম থেকে বহু প্রয়োজনীয় ও মুল্যবান জৈবিক কণা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে ওয়েমান ও তার পিএইচডি পরামর্শক, ইয়েল ইউনিভার্সিটির ডেরেক ব্রিগস পরিকল্পনা করছেন, এমন পদ্ধতিতে কাজ করার যাতে কোটি বছরের পুরনো জীবাশ্ম থেকেও ভেঙ্গে যাওয়া প্রোটিন কণা থেকে তথ্য উদ্ধার করা যায়। এমন ধরনের কনা-সংরক্ষনের নিশ্চয়ই কোন পদ্ধতি থাকবে, কিন্তু আমরা এখনো জানতাম না”-ওয়েম্যান বলেন।

ওয়েম্যান এবং ব্রিগস দেখিয়েছেন, উপযুক্ত পরিবেশে একটি প্রানীর মৃত্যুর সপ্তাহ, এমনকি মাস পার হলেও কোষীয় প্রোটিন, লিপিড (তেলজাতীয় পদার্থ) ও চিনির সাথে বিক্রিয়া করতে পারে। সেসময় উৎপন্ন পদার্থটি কঠিনপ্রকৃতির পলিমারে পরিনত হয় যা পানি নিঃসৃত করে জীবাণু আক্রমন রোধ করে এবং তাপসহগুণবিশিষ্ট। রাসায়নিকভাবে এই পলিমারগুলি, রান্নার সময়ে পুড়ে যাওয়া মাংস বা রুটির মত, তবে অগুনিতকাল টিকে থাকার উপযোগী।

অপরদিকে কিছু গবেষক দাবি করেন, তারা কোটি বছরেরও বেশি পুরনো, ডাইনোসরকালীন সময়ের অক্ষত প্রোটিন খুঁজে পেয়েছেন, তবে প্রাগৈতিহাসিক সংরক্ষন ব্যবস্থা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উঠেছে। “এত দীর্ঘসময় পরেও প্রোটিনগুলি কিভাবে অপরিবর্তিত থাকতে পারে, সেটা কেউই ব্যাখ্যা করতে পারেনি”- বলেন আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্ক-এর জীবাশ্মবিদ মারিয়া ম্যাকনামারা। ওয়েম্যান “অতি সুচারুভাবে প্রস্তাবনা করেছেন” কিভাবে প্রোটিনগুলি টিকে ছিল।

ওয়েম্যান ও ব্রিগস তত্ত্বীয়-প্রমাণ-গবেষনাপত্রের পর, ঝুঁকিমুক্ত কৌশল প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন, নমুনাটির উপর লেজার চালনা করে প্রাগৈতিহাসিক রাসায়নিক বন্ধন উন্মোচন করার জন্য। এই সপ্তাহের অস্ট্রেলিয়ার একটি মিটিঙে তারা রিপোর্ট করতে চাইছেন, কিভাবে প্রোটিন-অবশেষ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যাখ্যা করে মেরুদন্ডী প্রাণীদের বংশতালিকায় কচ্ছপের অবস্থান এবং সমর্থন করে “টেরোসোরাস- উড়বারক্ষমতাবিশিষ্ট বৃহত্তম প্রাণী উষ্ণরক্তবাহী ছিল।

ম্যাকনামারা বলেন, “ কৌশলটি নতুন বলে অন্যান্য ফসিলের উপরে প্রয়োগ করে যাচাই করা উচিত।” একইসাথে বিবর্তনমূলক রহস্যের সমাধান একনিমেষে এই কৌশলটি করতে পারবে বলেও সংশয় আছে। তবে তিনি আরো অনেকের সাথেই, কৌশলটির সাফল্য নিয়ে আশাবাদী। “সংরক্ষনব্যবস্থার সম্পূর্ণ নতুন একটি অধ্যায় এটি। উনারা আলোকপাত করছেন “কারণ” এবং “কিভাবে” নিয়ে।” বলেন বেইজিং-এর ইনস্টিটিউট অফ ভারটিব্রেট পাল্যিন্টোলজি ও পাল্যিন্থ্রপলজি-এর জীবাশ্মবিদ জিংমাই ও’কনর। “এটি বিস্ময়কর যে ওয়েম্যান বিপ্লব ঘটাচ্ছেন আমাদের গবেষনায়, তাও এমন একটি ক্ষেত্রে রসায়নকে কাজে লাগাচ্ছেন যেখানে সেটি খুবই কম প্রয়োগ করা হয়েছে।”

তবে ওয়েম্যান-এর মতে, লক্ষাধিক বছর পরেও জৈবকণাগুলির টিকে থাকার প্রথম সূত্র ডাইনোসরের ডিম থেকে পাওয়া যাবে। আন্দারগ্র্যাজুয়েট এবং মাস্টার্স-এর ছাত্রী হিসেবে তিনি জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ বন-এর মারটিন স্যান্ডার-এর নেতৃত্বাধীন দলে কাজ করেছেন, যেখানে দেখা গেছে ৬৭মিলিয়ন বছরের পুরনো ডাইনোসরের ডিম নীলচে-সবুজ ছিল, সাদা নয়। বর্ণকণিকাগুলি আলাদা করার জন্য ওয়েম্যান ডাইনোসরের ডিমের খোসার টুকরা এমন একটি দ্রবণে মিশ্রিত করেন যেটি ক্যালসিয়ামকে অপসারণ করতে পারে। কয়েকবার তিনি টেস্টটিউবের তলানিতে তামাটে বর্ণের, নমনীয় পদার্থ লক্ষ করেন। মাইক্রোস্কোপে তলানীটির সাথে ডিমের খোসার জৈবিক গঠনের সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যায় এবং তিনি চিন্তা করেন সেখানে মূল নমুনার টিস্যু আছে কি না? “এটি দেখতে বেশ চমকপ্রদ” তিনি বলেন। তবে সময়স্বল্পতার কারণে তিনি যা দেখেছেন তার পরীক্ষাটি শেষ করতে পারেননি।

পিএইচডি করার জন্য তিনি ইয়েল-এর ব্রিগস-এর ল্যাবে যোগ দেন এবং সেখানেই তামাটে-তলানির পরীক্ষা করেন। জীবাশ্মের হাড়ের এবং দাঁতের টুকরো থেকে ক্যালসিয়াম-অপসারণকৃত অংশ থেকে তিনি আরো অবশিষ্ট পদার্থ জমা করেন। তিনি বলেন, ”তাজা প্রোটিনের থেকে নমুনার অবশিষ্ট প্রোটিন ভীষণ আলাদা।” তবে মাইক্রোস্কোপের নিচে এটি বিভিন্ন কোমল টিস্যু যেমনঃ রক্তবাহীনালি, কোষ এমনকি স্নায়ু-এর উপস্থিতিও নির্দেশ করে।

ব্রিগস, যিনি একজন দক্ষ “কোমল টিস্যু সংরক্ষক” এবং ওয়েম্যান লক্ষ করেন যে অবশিষ্ট জৈবিক পদার্থগুলি জীবাশ্মের একটি নির্দিষ্ট প্রকরণ থেকে পাওয়া যাচ্ছে; কালো বা তামাটে বর্ণের থেকে হালকা-রঙের পাথর যেগুলো অগভীর পানিতে জন্মে অথবা লৌহসমৃদ্ধ নুড়িপাথর। এমন পরিবেশ ক্ষারীয় বিজারকের মত আচরণ করে, যেহেতু এখানে প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন অণু, দ্রবণশীল ধাতব আয়ন এবং পানির অনুপ্রবেশ হার এবং টিস্যুকে ক্ষয় করতে থাকে - এক্ষেত্রে গ্লাইকোক্সিডেশন এবং লিপোক্সিডেশন নামের জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া হয়ে থাকে। খাদ্যবিজ্ঞানিরা এটিকে “মেইলারড বিক্রিয়া” নামে খুব ভালো ভাবে চিনে থাকেন, যখনই কিছু প্রোটিনকে, স্নেহকে বা চিনিকে টোস্ট, গ্রিল, ক্যারামালাইজ অথবা “বাদামী” কঠিন পলিমারে রুপান্তরিত করা হয় এবং সেটি সুস্বাদু হয়ে থাকে।

যেভাবে প্রাগৈতিহাসিক বন্ধন সময়ের সাথে টিকে ছিল
নির্দিষ্ট পরিবেশে মৃত প্রানীর একেক ধরনের প্রোটিন একেক ধরনের কঠিন পলিমারে পরিনত হয়। রমন স্পেক্ট্রোস্কোপিতে অগুনিত বছর আগের প্রোটিনের প্রকৃত রাসায়নিক বন্ধন আলাদা করা যায়।

সময় ও অনুভাঙ্গনের পরীক্ষা রমন স্পেক্ট্রোস্কোপিতে। লক্ষ-কোটি বছর আগে প্রোটিনের মাঝের যে বন্ধনগুলি কার্যকর ছিল, যেগুলি ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ঘনত্ব বিচার করে এমিনো এসিডের নির্ণয় করা হয়। (গ্রাফিক/ সায়েন্স) জেসমিনা ওয়েম্যান।

কৈশোরকাল থেকেই ওয়েম্যান ইউনিভার্সিটি পর্যায়ের জৈবরসায়নের ক্লাস করেছেন। “সে কারনে আমি মেইলারড বিক্রিয়া সম্পর্কে জানি, এও জানি কিভাবে একটি প্রোটিন থেকে পানিরোধী পদার্থ তৈরি হয়।”-তিনি বলেন। ধারণা করা হচ্ছে জীবাশ্ম টিস্যুগুলির ক্ষেত্রে এমন কিছু হতে পারে কি না।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওয়েম্যান রমন স্পেক্ট্রোস্কপি দিয়ে পরীক্ষা করছেন। “অনেক জৈবরাসায়নিক পদ্ধতিতে কোন একটি নির্দিষ্ট পদার্থের উপস্থিতি চিহ্নিত করা হয়। তবে রমন স্পেক্ট্রোস্কপি তার থেকেও বেশি বিশ্লেষণ করতে পারে।”- তিনি জানান। এটি কোন নমুনায় কোন প্রকৃতির রাসায়নিক বন্ধন কার্যকর সেটি লেজাররশ্মি ব্যবহার করে নির্ণয় করতে পারে। নির্দিষ্ট ধরনের বন্ধন নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে, এতে আলোকরশ্মিগুচ্ছের প্রতিফলনে ছাপ সৃষ্টি হয়। এই পরীক্ষার ফলে ওয়েম্যান ও ব্রিগস নিশ্চিত হন যে, তামাটে অবশিষ্ট পদার্থটি, গ্লাইকোক্সিডেশন ও লিপোক্সিডেশন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন জটিল পলিমার দিয়ে গঠিত। আধুনিক হাড় এবং ডিমের খোসার অংশকে কৃত্রিমভাবে জীবাশ্মতে পরিণত করে বিক্রিয়াশীল পরিবেশে উত্তপ্ত করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে, আধুনিক টিস্যুও একই ধরনের অবশিষ্ট পদার্থে পরিণত হয়। (“নেচার কমুনিকেশন” নভেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত রিপোর্ট।)

ভিন্ন রকমের প্রোটিন থেকে ভিন্ন রকমের পলিমার তৈরী হয়, তবে এই পরিবর্তনেও প্রাচীন অণুগুলোও কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধরে রাখে। অই পরীক্ষার ফলাফল থেকে প্রাচীন জীববিজ্ঞান গবেষণার নতুন কৌশল যেটি “প্রাচীন ডিএনএ এবং প্রোটিনের জন্য উপযোগী” পাওয়া সম্ভব- ব্রিগস বলেন। যদিও প্রাচীন ডিএনএ-এ প্রচুর জৈবিক তথ্য জমা থাকে, এটি খুব দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়। সে তুলনায় অক্ষত প্রোটিন ৪ মিলিয়ন বছর টিকে থেকে অন্য প্রজাতি থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে। “তথ্যগুলি পুনরদ্ধার করা সম্ভব।”- ওয়েম্যান বলেন। পলিমারগুলো একটি এমিনো এসিডের সম্পূর্ণ তথ্যক্রম বা ত্রিমাত্রিক গঠনের তথ্য জমা রাখতে পারেনা, তবে জটিল যৌগগুলো ভীষণ স্থায়ী, “অনেক দীর্ঘসময় টিকে ছিল”- ব্রিগস বলেন। ওয়েম্যান বলেন যে তারা কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বারজেস শেল থেকে ৫০০মিলিয়ন বছরের পুরনো জীবাশ্ম থেকে প্রোটিন সনাক্ত করেছেন।

দাবিটি অবিশ্বাস্য হলেও “রসায়নটি যুক্তিসঙ্গত।”- বলেন ইভান সেট্টা, যিনি ইলিনয়েসের শিকাগো-এর ফিল্ড মিউজিয়ামের একজন জীবাশ্মবিদ।”আপনি কখনো গ্রিলের থেকে দানাদার অংশ আলাদা করলে দেখবেন, সেখানের প্রোটিন অতি উচ্চ তাপমাত্রাতেও অক্ষত ও অদ্রবণীয় থাকে।”

প্রোটিনের তথ্য বিশ্লেষণ বোঝার জন্য ওয়েম্যান বিভিন্ন প্রজাতির জীবাশ্ম ও জীবিত প্রানীর ডাটাবেজ তৈরি করেছেন। এখন চেষ্টা করছেন ডাটাবেজ থেকে প্রাচীন জীবনের রহস্য বোঝার। সৌভাগ্যক্রমে ওয়েম্যান এমন একটি মিউজিয়ামের সাথে যুক্ত যাদের বিশাল সংগ্রহশালা আছে। ব্রিগস বলেন- “ পিবডি মিউজিয়ামে ১০০০০০ মেরুদন্ডী প্রাণীর জীবাশ্ম এবং ৪.৫ মিলিয়ন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর জীবাশ্ম আছে”। ওয়েম্যান সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা আলমারিতে থাকা জীবাশ্মের অপ্রকাশিত তথ্য খুঁজে বের করার জন্য পড়ালেখা করেন। “সন্ধ্যায় এসব খুঁজতে কালেকশন রুমে কেউই আসেনা, ব্যাপারটা বেশ মজার”- বলেন ওয়েম্যান।

সংগ্রহ করা নমুনা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি না থাকায় কিউরেটরেরা পড়ালেখার অনুমতি দেয়ে থাকেন। হল্রুমের নিচে ওয়েম্যান-এর অফিসে বিভিন্ন ভৌগলিক যুগের নমুনা সারি বেঁধে নাম-লেখা বাক্সে রাখা থাকে। তিনি বলেন-”কিউরেটররা খুশি হন নমুনা নষ্ট না করে কাজ করলে।”
একটা বড় মাইক্রোস্কোপেরমত দেখতে রমন স্পেক্ট্রোস্কোপে তিনি ১০০-এরও বেশি নমুনা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি উতাহ-এর কার্বন কাউন্টি থেকে “এলোসরাস”-এর নমুনা পরীক্ষা করেন, এটি এতই কালো যে চকচক করে; উয়োমিং-এর নামকরা “গ্রিন রিভার” এলাকার মাছের নমুনাও পরীক্ষা করেন। তবে উনি প্রথম আগ্রহী হন”ডেইনোকাস”-প্রজাতির (যেটি দ্রুত দৌড়াতে পারে এবং পাখিদের আদিপিতা বলে ধারণা করা হয়) নখের নমুনা নিয়ে এবং তাঁর প্রিয় নমুনা-”জীবাশ্মের ডিমের খোসা”।

এই ক্রমবর্ধমান ডাটাবেজ সাথে নিয়ে তিনি প্রথমে পরীক্ষা করেন আলোকরশ্মির ছাপ থেকে প্রাচীন প্রাণীদের মাঝে কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় কি না। বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মির সংখ্যা ও উচ্চতার অতি সামান্য পার্থক্য থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ডিমের খোসার নমুনা থেকে জাতিজনি তালিকায় অবস্থিত একডজন ডাইনোসর, যার মধ্যে আদিপক্ষীও রয়েছে, প্রত্যেককে আলাদা করা যায়। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে “দি সোসাইটি অফ ভারটিব্রেট প্যালিন্টোলজি”-এর মিটিং-এ ওয়েমান জানাতে চাইছেন যে দাঁত ও হাড়ের নমুনা সাথে পরিচিত প্রজাতির ৬০% মিল পাওয়া গেছে।

ডেরেক ব্রিগস (বামে) এবং জেসমিনা ওয়েম্যান (যারা পরিক্ষা করে দেখেছেন কিছু নমুনা প্রোটিন অবশিষ্ট ধারণ করে) ইয়েল ইউনিভার্সিটির পিবডি মিউজিয়ামে জীবাশ্ম দেখছেন। (ছবিঃ লিন্ডসে লিগার)

“ এমন না যে আপনি ১০টি হ্যাড্রোসার একটি তালিকাতে সম্পর্কিতভাবে খুঁজে পাবেন। তবে কচ্ছপের, পাখীর, কুমিরের ছোট অংশ পেতে পারেন যার ভিত্তিতে এক প্রজাতি থেকে অন্যটি আলাদা করা সম্ভব”-তিনি বলেন।

এই মিটিং-এ আরেক অংশে ওয়েম্যান এবং ব্রিগসের সহকর্মী ডাল্টন মেয়ার বক্তব্য দিবেন, রমন স্পেক্ট্রা থেকে বিভিন্ন সরীসৃপের হাড়ের নমুনার তুলনা থেকে কচ্ছপের অবস্থান সরীসৃপতালিকার কোথায় হবে (এটি একটি জটিল প্রশ্ন) - তিনি সেটা আলোচনা করবেন। স্পেক্ট্রা থেকে পাওয়া তথ্যমতে কচ্ছপের পূর্বপুরুষ যেটি ২০০মিলিয়ন বছর আগের জীব, সেটি কুমির, সাপ এবং টিকটিকি থেকে ডাইনোসর এবং বর্তমান পাখিদের সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।

ওয়েম্যান, ব্রিগস এবং তাদের সহকর্মীরা এই পদ্ধতিটি আরো পুরনো নমুনার উপরেও প্রয়োগ করেছেন। “ট্যালিমন্সট্রাম” যা ট্যালি মনস্টার নামেও পরিচিত, ইলিনয়েসের ম্যাজন ক্রিক-এর একটি অদ্ভুত জীবটি ৩০০ মিলিয়ন বছরেরও আগে জীবিত ছিল এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা এটির সব তথ্য জানতে পারেননি। কোমল গঠনের দীর্ঘাঙ্গের ডিম্বাকার জীব যাকে কখনো মেরুদন্ডী, কখনো সূত্রাকার কীট, আবার কখনো সাঁতারু শামুক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভিক্টোরিয়া ম্যাকয়, যিনি ব্রিগসের ল্যাবে কাজ করেছেন, গ্রাজুয়েট হয়ে এখন মিলাওয়াকির উইস্কনসিন ইউনিভার্সিটিতে আছেন, আগামী মিটিং-এ রিপোর্ট করতে চান যে, রমন স্পেক্ট্রা থেকে প্রাণীদের দাঁতের তথ্য অনুযায়ী সেগুলো কেরাটিন অথবা কোলাজেন দিয়ে তৈরী, যে প্রোটিন কেবল মেরুদণ্ডী অথবা নিকটবর্তী প্রাণীদের শরীরে পাওয়া যায়। সেঅনুযায়ী, প্রানীগুলো কীট অথবা শামুক না হয়ে মেরুদণ্ডী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ২০১৬-এ নেচার-এ প্রকাশিত হয়, টালি মনস্টার -এর ১২০০ এর বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ম্যাকয়, ব্রিগস এবং তাদের সহকর্মীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। প্রোটিনের অবশিষ্ট অংশের বিশ্লেষণ “রাসায়নিক তথ্যের থেকে কোষীয় গাঠনিক বৈশিষ্ট্য বেশি নির্ভরযোগ্য এবং কম অস্পষ্ট” - বলেন ব্রিগস।

ওয়েম্যান মিটিং-এ আরো বলেন কিভাবে প্রোটিন বিশ্লেষণ করে কোন বিলুপ্ত প্রাণী উষ্ণরক্তবাহী কিনা নির্ণয় করা যায়। শক্তি উৎপাদনের জন্য কোষে যে বিক্রিয়াগুলি সম্পন্ন হয় সেখানে কিছু অতিরিক্ত পদার্থও তৈরি হয়, এদেরকে ফ্রি র‍্যাডিকেল বলে। ফ্রি র‍্যাডিকেল্গুলি মেলারড-বিক্রিয়ার মত প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং জীবাশ্ম প্রোটিন থেকে তৈরি পদার্থের মত পলিমার তৈরি করে। শীতলরক্তবাহী প্রাণীদের তুলনায় উষ্ণরক্তবাহী প্রাণীদের কোষে এই বিক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হয়। ওয়েম্যান বুঝতে পারেন জীবাশ্মকরণ প্রক্রিয়ায় মেইলারড বিক্রিয়া যুক্ত হলে নমুনাগুলির পার্থক্যকরণ করা সম্ভব। তিনি তাঁর পরীক্ষায় বর্তমান নমুনায় জীবাশ্মকরণ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে রমন স্পেক্ট্রামে পাওয়া দুইটি প্রধান রাসায়নিক বন্ধন আসলে বিপাকীয় গতি নির্দেশ করে।

তিনি ধারণাটি পরীক্ষা করেন এবং পরিকল্পনা করছেন যে মিটিং-এ তাঁর পরীক্ষার রিপোর্ট দেবেন, জীবিত প্রাণী ও জীবাশ্মের বিপাক-সম্পর্কিত প্রাপ্ত ফলাফল। স্তন্যপায়ী, টেরোসরস এবং দুইপাবিশিষ্ট ডাইনোসর যেমনঃ দ্রুতগতির এলোসরস ও ডেইনোনাইকাস, যারা চিহ্নিত উষ্ণরক্তবাহী প্রাণী।

স্তন্যপায়ীদের সাথে মিলবিশিষ্ট সরীসৃপ যারা ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে জীবিত ছিল, ধারণা করা হয় কদাচিৎ উষ্ণরক্তবাহী ছিল এবং চতুস্পদী ডাইনোসর যেমন ট্রাইসেরাটপস-এর বিপাকীয় গতি তুলনামূলকভাবে কমই ছিল। টিকটিকি এবং সাপদের পূর্বপুরুষ শীতলরক্তবাহী বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

ও’কনর বলেন, “আমরা কেবল হাড়ের গঠন অথবা মস্তিষ্কের আয়তন থেকে বিপাকীয় গতি নির্ণয়ের চেষ্টা করছি”। নতুন পদ্ধতিটি থেকে বিপাকের সরাসরি কোন সংযোগ পাওয়া যেতে পারে। তিনি ধারণা করছেন পাখিদের পূর্বপুরুষের বংশধারায় উষ্ণরক্তবাহিতা বারবার সংযুক্ত হয়েছে এবং আশা করছেন তাঁর ল্যাবে রমন স্পেক্ট্রা ব্যবহার করে পাখিদের জীবাশ্মের বিপাকীয় গতি নির্ণয়ের প্রোজেক্ট শুরু করবেন।

এথেন্সের ওহাইও ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ লরেন্স উইট্মার বলেন, “নমুনার অবশিষ্ট অংশ থেকে কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। একটি বিস্ময়কর অগ্রগামী পদক্ষেপ, একটি দারুন আবিষ্কার, যা এখনো আমরা দেখিনি।”

কিছু গবেষক দ্বিধা করছেন যে, পরীক্ষাগুলি ল্যাবে যথাযথভাবে করা হয়েছে কিনা। কেউ কেউ বলছেন, জীবাশ্মের নমুনায় ব্যাকটেরিয়াদূষণের প্রভাব ওয়েম্যান নিশ্চিতভাবে বিবেচনা করেছেন কিনা। সুইডেনের লান্ড ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ জোহান লিন্ডগ্রেন বলেন, “আপনি জানেন না আপনি কি নিয়ে পরীক্ষা করছেন, হতে পারে এটা আসল জীবাশ্ম, আধুনিক নমুনা, এমনকি দুইটির মিশ্রণ।”

ওয়েম্যান বলেন, ব্যাকটেরিয়া অথবা অন্যান্য দূষণ রমন স্পেক্ট্রাতে চিহ্নিত করা যায় এবং সেগুলো তিনি বিবেচনা করেছেন। তবে পিবডি শেলফে এখনো অনেক কিছু রয়েছে। তিনি বলেন, “আমাদের উচিত পদ্ধতিগুলোকে আরো সুচারু করা, যা একা কারো পক্ষে করা সম্ভব না। আরো অনেককেই এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে।”

রিপোর্টঃ এলিজাবেথ সিউল্টা, নিউ হেভেন, কানেকটিকাট।


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! আশা করা যায় এই প্রযুক্তি আর নিরলস গবেষণার মাধ্যমে দারুণ সব তথ্য পাওয়া যাবে। আপনাকে ধন্যবাদ মূল্যবান লেখাটার অনুবাদের জন্য।

হিমু এর ছবি

সচলায়তনে আরও লিখুন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

দারুণ! আরো লিখুন!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।