হুদাহুদি ০১

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বুধ, ১১/১০/২০১৭ - ৯:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাফজুলুম মারজুক ঢাকেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। শিক্ষক হিসেবে।

বলা উচিত ছিলো, হাফজুলুম মারজুক ঢাকেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কারণ শিক্ষকতা করলে চাকরিও করতে হয়। কিন্তু সেভাবে বললে ব্যাপারটা সঠিকভাবে বলা হয় না। হাফজুলুম মারজুক পূর্ণকালীন চাকরি করলেও শিক্ষকতাটা মাঝেমধ্যে করেন। কিছু কাজ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘনঘন করলে নানা সমস্যা দেখা দেয়, হাফজুলুম তাই শিক্ষকতাটা নিজের প্রয়োজনমাফিক করেন। ছাত্রদের বা বিভাগের প্রয়োজন নিয়ে তাঁর তেমন মাথাব্যথা নেই। অন্যের প্রয়োজনে নাক গলানো একটা বদভ্যাস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি একটা সোপান, তাতে গুটিকয়েক ধাপ। পুলিশ বা সামরিক বাহিনীতে যেমন ধাপের সংখ্যা গুণতে গেলে হাতের আঙুল ফুরিয়ে যায়, এখানে তেমন নয়। হাফজুলুম মারজুক সামরিক বাহিনীতে ঢুকতে চেয়েছিলেন, গোড়ালি এক করে দাঁড়াতে গেলে দুই হাঁটু একে অপরকে চুম্বন করে বলে শারীরিক বাছাইয়ে তিনি বাদ পড়ে যান। পুলিশে ঢোকার পরীক্ষাটিকেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নানা ধাপে কণ্টকিত করে রেখেছে, মারজুক একবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে ফিরে এসেছেন। বহুজাতিক ব্যাঙ্ক, দেশি ব্যাঙ্ক, দেশি টিভিকেন্দ্র, দেশি কম্পাঙ্কপ্রমূর্ছিত বেতারকেন্দ্রসহ আরো কয়েকটি ঘাটের জল পান করে, আর ঘোলা করে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করাটাই বরং ভালো হবে। সেখানে অতো বাছবিচার নেই, সদর দরজাটা অপ্রশস্ত বটে, কিন্তু খিড়কি দরজাটা চওড়াই। সর্বোপরি ঢাকেশ্বরীতে গোড়ালি এক করে দাঁড়াতে হয় না। সমস্যা ঐ একটিই, ওখানে ধাপ কম।

ধাপের সংখ্যার সাথে গোড়ালি এক করার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, চাকরি জীবনের কয়েকটি বছর বিমর্ষচিত্তে সে চিন্তায় কাটিয়ে একদিন আচমকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে একটি চিঠি পেয়ে মারজুক ঘাবড়ে যান। চিঠির সারবত্তা সরল, ছুঁড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে, এবার আপনাকে বকবক্তা থেকে পদোন্নতি দিয়ে সিকি অধ্যাপক করা হলো। তবে সিকি থেকে যদি আধুলিতে উঠতে চান, গবেষণা করে সাময়িকীতে নিবন্ধ ছাপাতে হবে।

হাফজুলুম মারজুক একই সাথে আনন্দিত ও ক্ষুব্ধ হন। প্রথম ধাপ যদি কালপ্রবাহের অমোঘ পরিণতি হয়, দ্বিতীয় ধাপে আবার এই গবেষণার হুজ্জৎ কেন? তাছাড়া গবেষণার সময় কোথায়? তিনি চিঠিটাকে দেরাজে ঠেসে ঢুকিয়ে বিরক্ত মুখে ডাইনোসর রোডের এক মিষ্টির দোকানের দিকে রওনা দেন। যদিও তখন একটি ক্লাসে তাঁর পাঠদানের সময়, কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পাঠাপাঠি কখনোই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।

তারপর কেটে যায় আরো কয়েকটি বছর। মারজুক ততোদিনে বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী ঘন ঘন অনুযোগ করেন, সিকি অধ্যাপকের স্ত্রীর জীবন তাঁর আর ভালো লাগে না। অমুক বিভাগের তমুকের স্ত্রী তাঁর সহপাঠিনী, সে তো গত বছরই আধুলি অধ্যাপকের স্ত্রী হয়ে গেলো। নানা দাওয়াতে-মেহফিলে দেখা হলে এখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয়, ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসে মারজুকপত্নীর মন্তব্যের সুযোগ রহিত করা। মারজুক ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেন, "আরে ধুত্তেরি গবেষণা ছাড়া পদোন্নতি মেলে না ঢাকেশ্বরীতে! সময় কোথায়?" তারপর রেগেমেগে বেরিয়ে যান একটি টিভিকেন্দ্রের বকবকানুষ্ঠান বরাবর। আজ সেখানে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের কুফল নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি, গতকাল করেছিলেন শিশুস্বাস্থ্যের ওপর মায়ের শালদুধের প্রভাব নিয়ে, গত পরশু করেছিলেন হরমুজ প্রণালী নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সমরনীতি নিয়ে। মারজুক কোনো কিছু নিয়ে বকতে পিছু হটেন না। কারণ একবার কোনো টিভিকে না করে দিলে সে শূন্যস্থানের সুযোগ নিয়ে আবডালে ওঁৎ পেতে থাকা তাঁর বাল্যশত্রু ও সিরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকি অধ্যাপক জুলকারিলেভেন হেকমতিয়ার এই বকবকানুষ্ঠানের চক্করে ঢুকে পড়বে। যদিও হেকমতিয়ার হিসাববিজ্ঞান পড়ায়, কিন্তু কয়লা-বিদ্যুৎ-বন্দর-রজস্রাব কোনো কিছু নিয়েই সে কম যায় না।

কিন্তু উইলিয়াম কনগ্রিভ নামে এক আদ্যিকালের সায়েবের কথাকে বিগড়ে বাকি সায়েবরা বলেন, হেল হ্যাথ নো ফিউরি লাইক আ উওম্যান স্কর্নড। মারজুকপত্নীর সেই সহপাঠিনীর পতিটি দিনরাত গবেষণা করে আর নিবন্ধ লেখে, দেশে-বিদেশে নানা সাময়িকী খুললেই তার নিবন্ধ দেখে চোখব্যথা হয়। আরো ক'টি দুঃসহ বছর কোনোমতে কাটিয়ে এক দুপুরে হাফজুলুম মারজুক স্বীয় পত্নীর মারাত্মক গঞ্জনার মুখোমুখি হন। প্রকাশিত নিবন্ধের চাপে মারজুকপত্নীর সহপাঠিনীপতি ঢাকেশ্বরীর অমুক বিভাগের পূর্ণ অধ্যাপকের একটি আসন দখল করেছেন, আর সহপাঠিনীটি মারজুকপত্নীকে ফেসবুকে নাবন্ধু করে দিয়েছেন। পূর্ণ অধ্যাপকের স্ত্রী হয়ে সিকি অধ্যাপকের স্ত্রীর সাথে বন্ধুত্ব রাখাও তো এক জ্বালা, তাই না?

হাফজুলুম মারজুক ফুঁসতে ফুঁসতে ঢাকেশ্বরীর "সম্ভ্রান্ত প্রকৌশলী মোফাজ্জল দারাসাঁকো স্মৃতি হল"-এ তাঁর হলশিক্ষকের দফতরে ঢুকে গুম হয়ে বসে থাকেন। এমনিতেই দিনকাল তাঁর খারাপ যাচ্ছে। সিরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হতভাগা জুলকারিলেভেন হেকমতিয়ার কী করে যেন মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্যাপ নিয়ে চলে গেছে, সে এখন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্কাইপি মেরে এন্তার টিভিকেন্দ্রের বকবকানুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছে। তার ওপর এখন আবার ঘরে গবেষণার তাড়া। বিভাগ প্রশাসন তাঁকে চিঠি দিয়েছে, মাঝেমধ্যে ক্লাস নিয়ে পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখতে। ক্লাস নিতে হবে, গবেষণা করতে হবে, নিবন্ধ ছাপাতে হবে, আবার রাতের বেলা ঘরে ফিরে বৌয়ের গঞ্জনা সয়ে মাঝরাতে সরাসরি সম্প্রচারিত বকবকানুষ্ঠানে পোঁদপাকা হেকমতিয়ারের সঙ্গে আজ বন্যা তো কাল চালের দাম নিয়ে তর্ক লড়তে হবে। এ যে গোড়ালি এক করলে হাঁটুতে হাঁটুতে ঘষা লাগার চেয়েও মারাত্মক।

হাফজুলুম মারজুক গুম হয়ে বসে সাত-পাঁচ ভাবছিলেন, এমন সময় হল ক্যান্টিন ম্যানেজার বাকী বিল্লা এসে তাঁর দোরে ঘা মারে। হাফজুলুমের মেজাজ আরো চড়ে যায়। হতভাগা বাকী বিল্লা বহু বছর ধরে বিল আদায়ের জন্যে মাঝেমধ্যে এসে কাশে আর এটাসেটা বলে। হাফজুলুম যে হলে খেয়ে কোনোদিনও বিল শোধ করবেন না, সে কথাটা বিল্লা কেন বুঝতে চায় না?

কিন্তু আজ বাকী বিল্লা বকেয়া বিল নিয়ে কোনো টুঁ শব্দ করে না। প্রথমেই লম্বা সালাম দিয়ে বিগলিত বদনে সে বলে, "ছার দোয়া চাইতে আসলাম।"

হাফজুলুম ভারিক্কি চালে এটা-সেটা কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলেন, "হজে যাচ্ছেন নাকি?"

বাকী বিল্লা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, আর বলে, "না ছার। হজে যাওয়ার টেকা কই? আমার সব টেকা ছার শিয়ালে-কুকুরে খাইয়া ফেললো।"

মারজুক ভুরু কুঁচকে বাকী বিল্লার দিকে তাকান, কিন্তু বাকীর চেহারায় কোনো অসূয়া নেই। সে নির্বাণলব্ধ যোগীর জ্যোতি মুখে নিয়ে বলে, "নতুন একটা কারবারে হাত দিলাম ছার।"

হাফজুলুম উৎসাহ ফিরে পান। "আরেকটা ক্যান্টিন খুলছেন নাকি? কোথায়?"

বাকী বিল্লা জিভ কাটে। "না ছার। এই এক কেন্টিনই আমারে কবরে অর্ধেক টাইন্যা লইয়া গেছে। আরেক কেন্টিন খুইল্যা বাকি অর্ধেক সান্ধাইতে চাই না।" হাতে হাত ঘষে সে বলে, "একটা গবেষণা সাময়িকী খুলছি ছার।" মিটমিট করে সে আড়ে আড়ে চায়, আর বলে, "অমাইনষের কাছে টেকা মাংতে মাংতে তো বুড়া হইয়া গেলাম ছার, তাই এখন মাইনষের কাছে লেখা মাঙ্গি।"

এত পষ্টাপষ্টি অপমান ঠেলেও হাফজুলুমের বুকের ভেতর হঠাৎ যেন রংমশাল জ্বলে ওঠে। একটা গবেষণা সাময়িকীই তো দরকার এখন। কিন্তু নিজেকে সামলে বিরসবদনে তিনি বলেন, "তাই? ও আচ্ছা। ঠিকাছে, লিখবো নাহয়। কী নাম দিছেন সাময়িকীর?"

বাকী বিল্লা হর্ষোৎফুল্ল মুখে বলে, "নাম দিলাম ছার: বাকীর খাতা।"

হাফজুলুম ফের চটে ওঠেন, কিন্তু বাকী থামে না, বলে চলে। "নিজের নামে নাম না রাখলে ছার, নাম ফাটে না। পরথমে ভাবছিলাম নাম দিমু ছায়েন্স, কিন্তু ঐ নামে একখান সাময়িকী কোন ব্যাডায় নাকি বাইর কইরা চালাইতাছে বহুদ্দিন ধইরা, এক ইশটুডেন কইলো। আমি তারে কইলাম ছার তাইলে "দি আদি ছায়েন্স" নাম রাখি? সে কয়, বাকী মিঞা, গবেষণা সাময়িকী তো ভাতের হোটেল না, ঐ ফরমুলা এইখানে খাটবো না। তখন কয়েকদিন চিন্তা কইরা ঠিক করলাম নাম রাখমু, নেচার! কিন্তু আরেক ব্যাডায় নাকি ঐ নামটাও হাতায় লইছে। এরপর আরো কত টেরাই দিলাম ছার, ডিশকনারির সুতা খুইল্লা ফালাইলাম দাগাইতে দাগাইতে, কিন্তু যেই নামই বাইর করি, কোনো না কোনো সুমুন্দির প্যাটে ঐটা গ্যাছেগা। শ্যাষম্যাশ ঠিক করলাম, যা আছে কিসমতে, বাকীর খাতাই সই।" আড়চোখে সে হাফজুলুমের আঁধার মুখটা খানিক খতিয়ে দেখে গুনগুনিয়ে বলে, "আমার খাতাটা তো ছার, সাদাই পইড়া রইছে। কিছু লেইখাও তো লাভ নাই, হুদাই কালি নষ্ট। তাই ভাবলাম, বাকির খাতার চিন্তা বাদ। বাকীর খাতায় যদি আপনেরা যারা গানীগুনী ছারেরা আছেন, তারা মাসে মাসে একটা দুইটা কইরা গবেষণা লিখেন, তাইলে হয়তো...।"

বেয়াদব ও অর্থগৃধ্নু বাকী বিল্লার প্রস্তাবে রাজি হয়ে তাকে হাঁকিয়ে দিয়ে হাফজুলুম আপিসের কম্পিউটারে গুগল খোলেন। এতো বছর ঢাকেশ্বরীর আলোহাওয়ায় থেকেও শিক্ষা মরমে পশেনি ব্যাটার, বকেয়া শোধের কথা তোলে। কতো সালমানখাঁ-আমীরখাঁ রাষ্ট্রের ব্যাঙ্কের তহবিল ফাঁকিয়ে গ্রিনগটসের গহ্বর বানিয়ে দিলো, আর দু'টাকার বাকী কয়েক লাখ বকেয়া শোধ পাওয়ার স্বপ্ন দেখে বেড়ায়। কিন্তু বাকীর খাতা সাময়িকীতেই নিবন্ধ লিখবেন তিনি। ঢাকেশ্বরীর এই পদোন্নতির ফ্যাসিবাদী নিয়মকে তিনি একহাত নিয়েই ছাড়বেন।

চাকরির ফাঁকে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে এ ব্যাপারে খুঁটিয়ে আলাপ করেন। একটি বকবকানুষ্ঠানে অধ্যাপক আসিফ নিজামরুলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যায়, নিজামরুল বাকীর খাতার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ওখানে তিনি নিয়মিত লিখবেন বলে ভাবছেন। ঢাকেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয়ও পদোন্নতির জন্যে বাকীর খাতায় প্রকাশিত নিবন্ধগুলোকে বিবেচনায় নেবে, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বাকী বিল্লার ক্যান্টিনের মান নিয়ে অবশ্য অধ্যাপক নিজামরুল অসন্তোষ প্রকাশ করেন, বলেন যে দিন দিন মান এমন নামতে থাকলে ওখানে খেয়ে বিল বকেয়া ফেলায় তিনি দীর্ঘমেয়াদী বিরতি দেবেন বলে ভাবছেন। অধ্যাপিকা ইয়ামেনা মহিষীণও আরেকটি বকবকানুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিরতির অবকাশে বাকীর খাতার সুনাম করেন হাফজুলুমের কাছে, বলেন, "আরে ইয়ে সাময়িকী তো বহুত আচ্ছে হ্যায়, হাম উসমে হর হফতে এক আর্টিকেল ভেজেঙ্গে। লেকিন আপ জারা বাকী বিল্লাকো বলে দিবেন যে উসকা ক্যান্টিনমে জো "মামলুকি মামলেট" হ্যায় না, ও দিন দিন সাইজমে ছোটা হো লাগনে হ্যায়। দিস শুড স্টপ।"

ভরসা পেয়ে হাফজুলুম মারজুক গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাড়িতে তাঁর স্ত্রীর কজ্জলিত মুখ প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে তাঁর অগ্রগতির খোশনবেদ শুনে।

মাসখানেক হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে হাফজুলুম তাঁর প্রাথমিক গবেষণাকে গুছিয়ে একটি নিবন্ধ দাঁড় করিয়ে ফেলেন। মিশেল ফুকো নামে একটি লোক আছে, মূলত তার লেখা থেকেই পঁচাত্তর শতাংশ গবেষণা ঘাপিয়ে দেন মারজুক। কিন্তু ঐ পঁচাত্তর শতাংশ খুঁজে পেতেই তার নাভিশ্বাস উঠে যায়। ঢাকেশ্বরীর ছোটোলোক কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের আপিসে দুইশো ছাপ্পান্ন কেবিপিএসের সংযোগ দিয়ে রেখেছে, এখান থেকে কী করে বিশ্বমানের গবেষণা হবে? উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন এত উন্নতি করছে, মারজুক হাড়ে হাড়ে টের পান। ওখানে বসে মিশেল ফুকোর লেখাজোকা নির্ঘাত আলোর বেগে ডাউনলোড করা যায়।

কিন্তু সেদিনই সম্ভ্রান্ত প্রকৌশলী মোফাজ্জল দারাসাঁকো স্মৃতি হলের ক্যান্টিনে খাওয়ার ফাঁকে হাফজুলুম বিষম খান। কেন্টিনের কোণে আপন ঠেকের পেছনে আসনে একটি পা তুলে বসে বাকী বিল্লা রংপেন্সিল কামড়াতে কামড়াতে মিশেল ফুকোর "দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার" পড়ছে, আর মাঝেমধ্যে তার বাকির খাতায় কী যেন হিজিবিজি নোট নিচ্ছে।

হাফজুলুমের মেজাজটাই তিরিক্ষি হয়ে যায়, হ্রস্বীভূত মামলুকি মামলেট আর আলুপরোটা তাঁর কাছে বিস্বাদ ঠেকে, কোনোমতে মালাই চা জবরদস্তি পান করে একটি খবরের কাগজের প্রাচীন পাতায় মুখ ঢেকে তিনি ক্যান্টিন থেকে পলায়নের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। আপিসে তাঁর নিবন্ধ পুরোটা তৈরি এখন, মুদ্রকের খাঁজ থেকে ছাপা পাতাগুলো নিয়ে বাকীকে ডাকিয়ে এনে তার হাতে তুলে দেওয়াই বাকি শুধু, আর বদমাশ বাকী বিল্লা কি না দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার পড়ছে? ওটা থেকেই তো গবেষণা করেছেন তিনি।

বাকী বিল্লা পত্রিকার পাতার আড়ালে হাফজুলুম মারজুককে শনাক্ত করে নিজের ঠেক ছেড়ে ছুটে এসে সালাম ঠোকে। "আচ্ছালামুয়ালাইকুম ছার! ছার ছার আমার লেখাটা?"

হাফজুলুম যেন বাকীর প্রশ্নে ঝাঁকি খেয়ে প্রবৃত্তির চাপে বেজার হয়ে বলেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ দেখা যাবে।"

বাকী বিল্লা জিভ কেটে বলে, "না না ছার টেকার কথা কই না তো, যে দেখা যাবে। দেখা যাবে এমন জিনিস নিয়া আপনারে জ্বালাইতে চাই না ছার। কই লেখার কথা। লেখাটা তো ছার, দিতে হবে।"

হাফজুলুম গলা খাঁকরে বলেন, "এই তো, একটা লেখা লিখছি। শেষ হোক।"

বাকী বিল্লা অনুযোগের সুরে বলে, "একটু ভালা কইরা লেইখেন ছার। কী যে দিনকাল পড়ছে। নিজামরুল ছার একটা লেখা দিছে, শতে পচাত্তর ছার মিশেল ফুকোর দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ারেত্তে দাগে দাগে টুকলি করা।" মিশেল ফুকোর অজর কীর্তির একটি লালক্ষেত সংস্করণ বাড়িয়ে ধরে সে। "চুরি দাগাইতে গিয়া রংপেন্সিল ছোডো হইয়া গেলো ছার। ছারেরা যদি এইভাবে মারে...।"

হাফজুলুম বজ্রদগ্ধ মন নিয়ে আপিসে ফিরে যান। বহু কাল ধরি বহু পেজ ঘুরে তিলে তিলে ডাউনলোড করা তাঁর তিলোত্তমা গবেষণা ফোল্ডারটির দিকে খানিকক্ষণ সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে থেকে ব্যথিত চিত্তে সেটি ডিলিট করে দেন। মিশেল ফুকো তাঁর অযুত কথামালা নিয়ে লয় পান। হাফজুলুম চোখের জল মুছে গুগল খুলে টাইপ করেন, এডওয়ার্ড সাইদ। বাঁচতে হলে মারতে হবে।

এরপর আরো একটি শ্রমঘন গবেষণাকণ্টকিত মাস কাটে। এডওয়ার্ড সাইদের ভাণ্ডার থেকেও হাফজুলুম মারজুক অনেকখানি গবেষণা করেন। কিন্তু এবার তিনি প্রভূত সতর্কতা অবলম্বন করেন। বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের তৃতীয়বর্ষীয় এক নম্বরলিপ্সু প্রথমস্থানার্থীকে অবৈতনিক গবেষণা সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কিছু ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ খুঁজিয়ে নেন তিনি, তারপর একটি সপ্তাহ হাড়ভাঙা খেটে সাইদের ফিলিস্তিনি ইংরেজিকে মেরামৎ করে বাকীর খাতার মাপে ছেঁটে আনেন। সবশেষে স্বস্তির শ্বাস ফেলে সম্ভ্রান্ত প্রকৌশলী মোফাজ্জল দারাসাঁকো স্মৃতি হলের ক্যান্টিন অভিমুখে পা বাড়ান তিনি। গবেষণা ক্ষুধা বাড়ায়।

ক্যান্টিনের ম্যানেজারি ঠেকে বাকী বিল্লাকে দেখতে না পেয়ে মারজুকের বুকে স্বস্তি ফিরে আসে। তিনি বেয়াড়া এক বেয়ারাকে ডেকে কড়া গলায় ফরমায়েশ ঠোকেন। একটি মাস পণ্ডশ্রম গেছে, বৌকে সেটা বোঝাতে গিয়ে ব্যাপক বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। মারজুকপত্নীর সহপাঠিনীটি থেমে নেই, তার পতিটিও পাগলা ঘোড়ার মতো গবেষণা করে চলছে, অচিরেই নাকি বিভাগের ডিন হচ্ছে সে। হতভাগার আপিসে ঢাকেশ্বরীর ফ্যাসিবাদী কর্তৃপক্ষ নির্ঘাত আলোকতন্তু টেনে বিলেতি ছাঁটের উচ্চগতির আন্তর্জাল সংযোগ দিয়েছে। ওদিকে এক বকবকানুষ্ঠানে অধ্যাপক নিজামরুলের সাথে মৃদু বাদানুবাদ হয়ে গেছে তাঁর। বাকী বিল্লা ফুকো পড়ে জেনে নিজামরুল বেশক অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তিনি সম্ভ্রান্ত প্রকৌশলী মোফাজ্জল দারাসাঁকো হলে এসব বই নিষিদ্ধ করার জন্যে প্রাধ্যক্ষকে চাপ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মারজুককে। সাময়িকী সম্পাদকও যদি লেখাপড়া শুরু করে দেয়, বলেছেন তিনি, তবে সমূহ বিপদ। বুদ্ধিটা খারাপ না, কিন্তু নিজামরুল জানিয়েছেন, তিনিও নাকি এখন ফুকো ফেলে সাইদ থেকে গবেষণা করবেন। মারজুক নিজামরুলকে এ সর্বনাশা পথ থেকে ফেরাতে চেয়েছেন, কিন্তু নিজামরুল কিছুতেই রাজি হননি। ইয়ামেনা মহিষীণও আরেকটি বকবকানুষ্ঠানে প্লাস্টিকের খেলনার ওপর ব্রেক্সিটের প্রভাব নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনার শেষে জানিয়েছেন, "মিশেল ফুকো ইজ ডেড। বাকী বিল্লা গট উইন্ড অফ দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার। হি ইজ ওয়ান কানিং জার্নাল এডিটর, আই হ্যাভ টু সে। আব জো গবেষণা করনা হ্যায় সব এডওয়ার্ড সাইদসে করেঙ্গে।"

এসব ভাবার ফাঁকে এক মাস আগের মামলুকি মামলেটের আশি শতাংশ আয়তনের সংস্করণ দিয়ে মাত্র পাঁচটি আলুপরোটা সেবন করতে না করতেই হাফজুলুমের বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে। ম্যানেজারি ঠেকের পেছন থেকে মেঝে ছেড়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে বিনিদ্র রক্তচক্ষু বাকী বিল্লা, তার এক হাতে এডওয়ার্ড সাইদের "কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম", আরেক হাতে ইংরেজির অলয় শব্দকোষ রজে'র থেসরাস, দাঁতে রংপেন্সিল। নির্ঘাত রাত জেগে বসে ওটাই পড়ছিলো হতভাগা।

সে রাতে বাড়ি ফিরে হাফজুলুম মারজুক হাগুঘরে বসে অনেক কাঁদেন, আর বিধাতাকে শাপান্ত করেন। অ্যাকিলিসের গোড়ালিজোড়াই লোকটা তাঁর হাঁটুতে দিয়ে রেখেছে।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

হাফজুলুম মারজুক চেষ্টা নিলে হয়তো বিভাগীয় কোন সামিয়ানার সাহায্য নিতে পারতেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

"সদর দরজাটা অপ্রশস্ত বটে, কিন্তু খিড়কি দরজাটা চওড়াই।" হা হা হা। দারুণ!

----মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পর একটা লেখা পড়ে খুব মজা পেলাম, কিন্তু মনে হলো চুরির অন্য অংশীদার বাদ পরে গেছে।
অতিথি

সোহেল ইমাম এর ছবি

ম্যানেজারি ঠেকের পেছন থেকে মেঝে ছেড়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে বিনিদ্র রক্তচক্ষু বাকী বিল্লা, তার এক হাতে এডওয়ার্ড সাইদের "কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম", আরেক হাতে ইংরেজির অলয় শব্দকোষ রজে'র থেসরাস, দাঁতে রংপেন্সিল। নির্ঘাত রাত জেগে বসে ওটাই পড়ছিলো হতভাগা।

গুল্লি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

পরিভাষা ভাল লেগেছে, বিশেষ করে 'কম্পাঙ্কপ্রমূর্ছিত' আর 'আলোকতন্তু'।

লেখা বরাবরের মতোই

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

দারুন! সিরিজের পরবর্তী পর্বগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।

তারেক অণু এর ছবি

"চুরি দাগাইতে গিয়া রংপেন্সিল ছোডো হইয়া গেলো ছার। ছারেরা যদি এইভাবে মারে...।" গুল্লি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এক বিশ্ববিদ্যালয়, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয়। তার ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতাপে দুপুরের সূর্য মহালয়া-কালীপূজোর রাতের চাঁদের মতো আলোহীন হয়ে যায়। তার এক সিকি নাকি আধুলী অধ্যাপক সেখানে শিক্ষকতা আর চাকুরীই শুধু করেন না সাথে গোপন রাজনৈতিক দলের সার্বক্ষণিক কর্মীদের মতো চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ষোল ঘন্টা বিভাগ আলো করে বসে থাকেন আর মাঝে মাঝে চা-সিঙ্গারা খান। নিন্দুকেরা বলে উনার মহিষী উগ্রচণ্ডী প্রকৃতির, প্রায়ই শুধু চ্যালাকাষ্ঠহস্তেসংহস্থিতা হন না সাথে সাথে যথাস্থানে উপযুক্ত বলে তা প্রয়োগও করে থাকেন। এই কারণে অধ্যাপক মহাশয় বিভাগীয় কক্ষেই অবস্থান করাটা নিরাপদ ও আরামদায়ক মনে করেন। কর্মজীবনের শুরুতে অধ্যাপক মহাশয় যখন বকবক্তা, তখন অতি কষ্টে ক্লাস লেকচার তুলোট কাগজে মোটা নিবের কালো কালির কলম দিয়ে লিখে নিয়েছিলেন (অথবা লিখিয়ে নিয়েছিলেন)। তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা গেলো, নাদের আলী বুড়ো হয়ে কবরস্থ হলো, নিখিলেশের চুল পেকে সাদা হয়ে গেলো, বরুণা লোলচর্ম বৃদ্ধা হয়ে গেলো কিন্তু সেই সিকি নাকি আধুলী অধ্যাপক মহাশয়ের তুলোট কাগজের লেকচার নোট অজর-অমর-অব্যয়-অক্ষয় হয়ে থাকে। বছরের পর বছর ক্লাসে সেগুলোই পঠিত হতে থাকে। এর মধ্যে অ্যাবাকাস স্লাইডরুলের পথ ধরে ক্যালকুলেটর হয়ে গেলো, কোর্সের কনটেন্ট কতবার পালটে গেলো কিন্তু সেই সিকি নাকি আধুলী অধ্যাপক তার লেকচার নোট আর পাল্টান না। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং-এ যখনই সিলেবাসে পরিবর্তনের কথা আলোচিত হয়, সিকি নাকি আধুলী অধ্যাপক মহাশয় অতিশয় উষ্মা প্রকাশ করেন। বেয়াদব পুলাপান বলে, "ছার, আপনের নোটের ল্যাখা তো পড়তাম পারি না। ফটুকপি করাইলে সাদা কাগজ বাইরায়। গেলো হাপ্তায় লালক্ষেতের ফটুকপির দোকানের মামা আপনের নোট দেইখাই কইলো - থাউক আর কষ্ট কইরা ফটুকপি করন লাগতোনা, এক দিস্তা সাদা কাগজ লইয়া যান, খর্চাও কম পড়বো"। এসব শুনে সেই সিকি নাকি আধুলী অধ্যাপক কিছু বলেন না। তিনি জানেন পুলাপানের কথায় কান দিতে নাই। তাদের কথায় কিছুই হয় না। এমনকি রেডিও-টেলিভিশন-পত্রিকা-ম্যাগাজিন-ব্লগ-সোশ্যাল মিডিয়া যেখানে যা কিছু বলা হোক এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন হবে না, কারো কিছু হবে না। ভিকটিম পুলাপান ভাবে সিকি নাকি আধুলী অধ্যাপকের তুলোট কাগজের লেকচার নোটগুলো তাম্রফলকে বা শ্বেত পাথরে খোদাই করে দিলে কেমন হয়! তাহলে এর পরে আরও কয়েক দশকে যারা এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবে তারা সেই ঐশী বাণীর মতো অপরিবর্তনীয় লেকচার নোটগুলো অন্তত পড়তে পারবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা ভালো হইছে । 'বাকীর খাতা' নামটা সেইরাম হইছে । তবে সামিয়ানা চোর-দৌড়ানিরে বাদ দিলেন কেন ?

মামুনুর রশীদ [ ভবঘুরে শুয়োপোকা ]
===================
mamun babu ২০০১ at gmail.com
হাজার মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুজে ফিরি

তাহসিন রেজা এর ছবি

গুল্লি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

তাহসিন রেজা এর ছবি

গুরু গুরু

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

দেবদ্যুতি এর ছবি

হো হো হো কী লেখা ভাই! জীবন ধন্য হয়ে গেছে পড়ে

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।