আকাশপথে ঘুমন্ত রূপবতীর সান্নিধ্যে

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শনি, ০৬/০৫/২০২৩ - ৯:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[দুটো কারণে গল্পটা অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথম কারণ: এ ধরণের একটা অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছিল বহুবছর আগে, থাই এয়ারওয়েজের সিউল-ব্যাংকক রুটের একটা ফ্লাইটে। তাই মার্কেজের লেখা এই গল্পটা পড়ে বিশেষ ভালো লেগেছিল। শুধু ভালো লাগলেই অনুবাদটা করতাম না যদি দ্বিতীয় কারণটি যোগ হতো। গল্পটি পড়ার পর বাংলা ভাষায় কেউ অনুবাদ করেছে কিনা খোঁজ নিতে গিয়ে কালি ও কলম পত্রিকায় ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি অনুবাদ পেলাম। কিন্তু সেই অনুবাদটি এত কুৎসিত যে মার্কেজের জন্য আমার রীতিমত করুণা হলো। তাঁর এত সুন্দর গল্পটাকে বাংলা ভাষায় এনে রীতিমত খুন করা হয়েছে। এই গল্পটা মার্কেজের জীবনের একটি সত্য ঘটনা নিয়ে লিখিত। ঘটনাটি তিনি Sleeping Beauty on the Airplane শিরোনামে লিখেছিলেন মেক্সিকো থেকে প্রকাশিত Proceso নামের একটি পত্রিকার ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সংখ্যায় ]

মেয়েটা ছিল অতীব সুন্দরী। গায়ের রঙ বাদামী, সবুজ অ্যালমণ্ডের মতো দুটো চোখ আর কাঁধ পর্যন্ত নেমে যাওয়া ঘন কালো চুল। চেহারার মধ্যে এমন একটা প্রাচীন আভিজাত্যের ছাপ, বোঝার উপায় নেই ইন্দোনেশিয়া থেকে আন্দেজের মধ্যে কোন অঞ্চলের বাসিন্দা। পোশাক আশাকে সূক্ষ্ণ এবং মার্জিত রুচির ছাপ। একটা লিংক্স জ্যাকেটের সাথে হালকা রঙের ফুলের ছাপা সিল্কের ব্লাউস পরেছে। ঢিলেঢালা লিনেনের পাজামার সাথে পরেছে বোগেনভিলিয়া রঙের ফ্ল্যাট জুতো।

মেয়েটাকে দেখামাত্র মনে হলো ‘এ আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে রূপবতী নারী।’ প্যারিসের শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্টে নিউইয়র্কগামী ফ্লাইটের চেক-ইন কাউন্টারে দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়েটা তখন গর্বিত সিংহীর মতো দৃঢ় পদক্ষেপে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। যেন এক অলৌকিক ছায়ামূর্তি হয়ে ক্ষণকালের জন্য আবির্ভূত হয়ে আবার টার্মিনালের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।

সকাল নটা বাজে তখন। আগের দিন সারা রাত ধরে তুষারপাত হয়েছিল। শহরের রাস্তায় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ভিড়। এমনকি হাইওয়েতেও ধীর গতি ছিল, যেখানে ট্রেলার লাগানো ট্রাকগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ছিল। মোটর গাড়িগুলো তুষারে আটকা পড়ে তারস্বরে হর্ণ বাজাচ্ছিল। তবে এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভবনের ভেতরে তখনো বসন্তের আমেজ।

আমি এক বয়স্ক ডাচ মহিলার পেছনে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম যিনি প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে তাঁর এগারোটি স্যুটকেসের ওজন নিয়ে তর্কবিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এইসব দেখে দেখে যখন আমি বিরক্তিকর সময় পার করছিলাম তখন মুহূর্তের জন্য ওই মেয়েটির অলৌকিক আবির্ভাব। এক ঝলক দেখেই আমার হুঁশজ্ঞান এমন বেচাল হয়ে গিয়েছিল যে টেরই পাইনি শেষমেষ ওই বুড়ির মালপত্রের ওজনের সুরাহা কিভাবে হলো। টিকেট ক্লার্কের মৃদু তিরস্কারে আমি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এলাম। একটু কাচুমাচু হয়ে কাউন্টারের মেয়েটার কাছে জানতে চাইলাম সে প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ায় বিশ্বাস করে কিনা। মেয়েটা কম্পিউটার পর্দায় চোখ দুটো আটকে রেখেই জবাব দিল, ‘অবশ্যই। অন্য কোন ধরনের প্রেমই অসম্ভব ব্যাপার।’ তারপর জানতে চাইল আমি স্মোকিং নাকি নন স্মোকিং সিট চাই।

আমি একটা কপট বিদ্বেষের সুর টেনে বললাম, ‘যে কোন একটা হলেই চলবে। শুধু ওই এগারো স্যুটকেসের মহিলার পাশে যেন না হয়।’

সে একটা পেশাদার হাসি দিয়ে ব্যাপারটাকে যেন আমলে নিল। তবে কম্পিউটারের উজ্জ্বল পর্দা থেকে চোখ দুটো একবারও সরালো না।

‘তিন, চার, সাত থেকে যে কোন একটা নাম্বার বেছে নিন”
‘চার’
মেয়েটার মুখে বিজয়ীর হাসি। বললো, ‘পনের বছর ধরে এখানে কাজ করছি। আপনিই প্রথম যিনি সাত বেছে নেননি।’

সিট নাম্বারটা লিখে মেয়েটা বোর্ডিং পাসটা আমার কাছে ফেরত দিল বাকী কাগজপত্রের সাথে। তারপর প্রথমবারের মতো আমার দিকে তাকালো আঙুরের মতো চোখ দুটো দিয়ে। সেই চোখ ধাঁধানো রূপবতীকে আবারো দেখার আগ পর্যন্ত ওই আঙুর চোখের দৃষ্টিকেই সান্ত্বনা হিসেবে মেনে নিলাম। ঠিক তখনই মেয়েটা জানালো যে এয়ারপোর্টটা এখুনি বন্ধ হয়ে যাবে এবং আজকের সব ফ্লাইট দেরিতে ছাড়বে।

‘কতক্ষণ দেরি হবে?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘খোদা জানেন কত দেরি হবে,’ মেয়েটা মৃদু হেসে জানালো। ‘আজ সকালে রেডিওতে বলেছে এটা বছরের সবচেয়ে বড় তুষারপাত হতে যাচ্ছে।’

ভুল বলেছিল মেয়েটা। ওটা ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে বড় তুষারপাত। কিন্তু সেই প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং রুমে বসন্তকেই সত্যি বলে মনে হচ্ছিল টবে সাজানো তাজা গোলাপের সুবাসে। এমনকি স্পিকার থেকে ভেসে আসা মৃদু সঙ্গীতের মূর্ছনায় এমন একটা ঘোর লাগা অনুভূতি তৈরি হয়েছিল মনে হচ্ছিল সঙ্গীতের স্রষ্টা বুঝি এটাই চেয়েছিল। সব মিলিয়ে এই জায়গাটিই সেই রূপবতীর উপযুক্ত আশ্রয় বলে মনে হলো। আমি একটু সাহসী হয়ে আশপাশের সবগুলো অপেক্ষমান জায়গাগুলোতে খুঁজলাম ওকে। কিন্তু যাদের দেখলাম তাদের অধিকাংশই বাস্তব জগতের পুরুষ মানুষ যারা বসে বসে ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ছে। পাশে বসা তাদের স্ত্রীরা টার্মিনালের প্রশস্ত জানালা দিয়ে তুষারে স্থবির হয়ে থাকা প্লেন, হিমবাহের স্তুপ আর তুষারঝড় নামক সিংহের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে পড়া রোইসি প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে হয়তো অন্য কারো কথা ভাবছে।

দুপুরের মধ্যে দেখা গেল ওয়েটিং রুমে আর এক ফোঁটাও বসার জায়গা নেই। গরমটা এত অসহ্য হয়ে উঠল যে আমি নিঃশ্বাস নেবার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে আসার পর অভিভূত হয়ে পড়ার মতো দৃশ্য দেখা গেল। দুনিয়ার সব লোক এসে ওয়েটিং রুমগুলোতে ঢুকে পড়েছে। উত্তপ্ত করিডোরের সবটুকু জুড়ে, এমনকি সিঁড়ির মধ্যেও লোকজন ক্যাম্প করে বসে আছে। তাদের মালপত্র, পোষা জন্তু, বাচ্চাকাচ্চা, সবকিছু নিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে বসেছে সবাই। শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বলে এই অবস্থা। বাইরে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের তৈরি প্রাসাদটাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা অতিকায় মহাশূন্যযান ঝড়ের মধ্যে খাবি খাচ্ছে। এ অবস্থায়ও আমার মাথায় সেই রূপবতীর কথা ঘুরছিল। মেয়েটা নিশ্চয়ই ওই ভিড়ের মধ্যে কোথাও আছে। সেটা কল্পনা করে আমার কাছে অপেক্ষার সময়টা আনন্দদায়ক মনে হল।

দুপুরে খাবারের সময়েই আসল বিপদটা টের পাওয়া গেল। সাতটা রেস্টুরেন্ট, ক্যাফেটেরিয়া, বার সবগুলোতে বিশাল লাইন লেগে গেছে। তিন ঘন্টার মধ্যে সব খাবারদাবার শেষ হয়ে গেলে ওরা রেস্তোঁরা বন্ধ করে দিল। কোন খাদ্য কিংবা পাণীয় কিছুই অবশিষ্ট নেই কোথাও। বাচ্চাগুলো একযোগে এমনভাবে কাঁদতে শুরু করলো যে মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সব শিশু এখানে জড়ো হয়েছে। ঠাসাঠাসি ভিড় থেকে একটা চাপা দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করলো। আমি নিরুপায় অবস্থা দেখে সহজাত বুদ্ধি খাটিয়ে বাচ্চাদের একটা দোকানে গিয়ে কোনমতে দুকাপ ভ্যানিলা আইসক্রিম পেলাম। ওটাই শেষ আইটেম ছিল। ওয়েটারেরা সেখানে চেয়ার টেবিল গুটিয়ে দোকান বন্ধ করার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আমি কাউন্টারে বসে আয়েশ করে আস্তে আস্তে আইসক্রিম খেতে শুরু করলাম। খেতে খেতে সামনের আয়নার মধ্যে ছোট্ট কার্ডবোর্ডের কাপ আর চামচ হাতে বসে থাকা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সেই রূপবতীর কথা ভাবলাম।

নিউইয়র্কের যে ফ্লাইটটা সকাল এগারোটায় ছাড়ার কথা ছিল, সেটা ছাড়লো রাত আটটায়। আমি প্লেনে ওঠার আগেই অন্য সব ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জার তাদের আসন দখল করে বসে পড়েছিল। একজন অ্যাটেনডেন্ট আমাকে নির্ধারিত আসনের দিকে নিয়ে গেল। সেখানে পৌঁছেই আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আমার ঠিক পাশের আসনে বসে আছে মেয়েটা! জানালার দিকের আসনটাতে অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীর ভঙ্গীতে বসে আছে রূপের পসরা নিয়ে। আমি ভাবলাম ‘যদি কখনো এই ঘটনা লিখি, কেউ বিশ্বাস করবে না।’ আসনে গিয়ে বসার সময় আমি অস্ফুট স্বরে তাকে একটা সৌজন্য সম্ভাষণ জানালাম। কিন্তু সেটা তার কানে পৌঁছেছে বলে মনে হলো না।

মেয়েটা তার আসনে এমনভাবে গুছিয়ে বসেছিল মনে হলো যেন কয়েকটা বছর ওখানেই কাটিয়ে দেবে। আদর্শ গৃহিনীর মতো জিনিসপাতি এমনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছিল যেন হাত বাড়ালেই দরকারী জিনিসটা পেয়ে যায়। তার আসন-সংসারের সবকিছু গোছানো শেষ হবার পর স্টুয়ার্ড এসে ওয়েলকাম শ্যাম্পেন অফার করলো। মেয়েটা সেটা প্রত্যাখ্যান করে ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে কিছু একটা বোঝাতে চাইল। স্টুয়ার্ড ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করলে মেয়েটা স্বস্তির হাসি দিয়ে তাকে ধন্যবাদ শুধু এক গ্লাস পানি চাইল। সেই সাথে এটাও জানিয়ে রাখলো পুরো ফ্লাইট টাইমে তাকে যেন কোন কারণেই জাগিয়ে তোলা না হয়। তার উষ্ণতা মেশানো গম্ভীর কণ্ঠের মধ্যে প্রাচ্য দেশের বিষণ্ণতা কানে বাজলো।

স্টুয়ার্ড যখন পানি নিয়ে ফিরে এলো তখন মেয়েটা তার কোলের ওপর চৌকোনা একটা বাক্স খুলে বসেছে। বাক্সটার কোনাগুলো আমাদের দাদীর আমলের ট্রাংকের মতো তামার পাতে মোড়ানো। বাক্সের ভেতরে একটা খোপের মধ্যে থাকা নানা রঙের বড়ি থেকে দুটো সোনালী বড়ি তুলে নিয়ে পানি দিয়ে গিলে ফেলল। তার এসব কাজের মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো ছিল না। সবকিছু ধীরে সুস্থে এমন সুশৃংখলভাবে করছিল, মনে হচ্ছিল জন্ম থেকে সে কখনো কোন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। সব গোছানো শেষে মেয়েটা জানালার শাটারটা নামিয়ে দিল, সিটটা পেছনদিকে যতদূর নেয়া যায় ততদূর হেলান দিল, জুতোটুতো না খুলে কোমর পর্যন্ত শরীরটা ঢেকে ফেলল কম্বল দিয়ে। তারপর চোখের ওপর স্লিপিং মাস্ক পরে আমার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে পড়লো। মুহুর্তের জন্যও কোন বিরতি কিংবা দীর্ঘশ্বাস কিংবা দেহভঙ্গির কোন পরিবর্তন ছাড়া টানা সাত ঘন্টা বারো মিনিট ঘুমিয়ে কাটালো প্লেনটা নিউইয়র্কে পৌঁছানো পর্যন্ত।

আমার জন্য ওটা একটা হৃদয়গ্রাহী ভ্রমণ ছিল। আমি সবসময় বিশ্বাস করি যে প্রকৃতিতে একজন সুন্দরী নারীর মতো মনোহর কিছু সৃষ্টি হয়নি। পুরো যাত্রা পথে আমি এক মুহূর্তের জন্যও আমার পাশে শুয়ে থাকা রূপকথার বই থেকে উঠে আসা অপ্সরীটার কথা ভুলে থাকতে পারিনি।

প্লেনটা আকাশে ওড়ার পরপর সেই স্টুয়ার্ড চলে গেল এবং তার জায়গায় এক বেরসিক অ্যাটেনডেন্ট এসে হাজির হল। সে একটা প্রসাধনী কেস এবং গান শোনার এক সেট ইয়ারফোন নিয়ে এসে অপ্সরীর ঘুম ভাঙ্গিয়ে সেগুলো দেবার চেষ্টা করলো। আমি তাকে বাধা দিয়ে স্টুয়ার্ডকে মেয়েটা যে নির্দেশ দিয়েছিল সেটা পুনরাবৃত্তি করে মেয়েটাকে বিরক্ত করতে বারণ করলাম। কিন্তু অ্যাটেনডেন্ট লোকটা ত্যাদর টাইপের। সে মেয়েটার নিজের মুখ থেকে কথাটা শুনতে চাইল। সেই সাথে মেয়েটা যে রাতের খাবার নেবে না সেটাও নিশ্চিত হতে চাইল। পরে স্টুয়ার্ড এসে মেয়েটার নির্দেশটা জানানোর পরও গোঁয়ার অ্যাটেনডেন্ট আমাকে খানিকটা তিরস্কারের সুরে বলল যে মেয়েটা ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ লেখা কার্ডবোর্ড গলায় ঝোলায়নি।

আমি একা একাই রাতের খাবার খেলাম চুপচাপ। খেতে খেতে নিঃশব্দে নিজের সাথে কথা বললাম। জেগে থাকলে মেয়েটাকে যেসব কথা বলতাম সেসব কথা। মেয়েটার ঘুম এতই স্থিতিশীল এতই নিশ্ছিদ্র যে এক পর্যায়ে আমি দুশ্চিন্তায় পড়লাম -মেয়েটা যে পিল খেয়েছিল সেটা ঘুমানোর জন্য নাকি মৃত্যুর জন্য? প্রত্যেকবার ড্রিংক্স নেবার সময় আমি মেয়েটার উদ্দেশ্যে টোস্ট করছিলাম,

‘তোমার মঙ্গল কামনায় হে রূপবতী’।

রাতের খাওয়া শেষ হবার পর মাথার ওপরের বাতিগুলো কমিয়ে দেয়া হলো। পর্দায় একটা মুভি চালিয়ে দেয়া হলো যদি কারো ইচ্ছে হয় দেখতে পারে। তখন সমগ্র পৃথিবীর অন্ধকার জুড়ে শুধু আমরা দুই নিঃসঙ্গ যাত্রী। এই শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড়টি শেষ হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন আগেই। আটলান্টিকের ওপর বিপুল অন্ধকারে ঢাকা রাতটা ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। আকাশজুড়ে অসংখ্য নক্ষত্রের মাঝে প্লেনটা যেন স্থির ভেসে আছে।

তারপর আমি মেয়েটার ভাবনায় ডুবে গেলাম। তার শরীরের প্রতিটা ইঞ্চির ওপর চোখ বুলিয়ে সেখানে প্রাণের লক্ষণ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে যেটুকু ধরতে পেরেছিলাম তা ছিল মেয়েটার কপালের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া ঘুমন্ত স্বপ্নের ছায়া। যেমন করে জলের ওপর ভেসে থাকে মেঘের ছায়া। মেয়েটার গলায় খুব সরু একটা চেইন আছে যেটা তার সোনালী ত্বকের ওপর প্রায় অদৃশ্য। তার কানের লতি ছিদ্রহীন, বাম হাতে একটা সাদামাটা ব্যান্ড পরেছে। যেহেতু তাকে দেখতে বাইশ বছরের বেশি মনে হচ্ছিল না, তাতে আমি নিজেকে প্রবোধ দিলাম- মেয়েটার আঙুলে ওটা নিশ্চয়ই বিয়ের আঙটি নয়। হয়তো কোন ক্ষণস্থায়ী সুখী মুহূর্তের স্মারক মাত্র।

মেয়েটা কোনরকম পারফিউম ব্যবহার করেনি। নিঃশ্বাসের সাথে মৃদু কাঁপতে থাকা দেহ থেকে থেকে যে সুগন্ধ ভেসে আসছিল সেটা তার শরীরের স্বাভাবিক ঘ্রাণ ছাড়া আর কিছু নয়।

এমন সময় হঠাৎ করে আটলান্টিক মহাসাগরের বাইশ হাজার ফুট ওপরে খেরার্দো দিয়েগোর সেই অবিস্মরণীয় সনেটের কথা মনে পড়লো আমার - You on your sleep and on the sea the ships(তুমি ঘুমিয়ে আছো সমুদ্রে ভেসে থাকা জাহাজে)।

সনেটের পুরোটা ঠিকঠাক মনে করার চেষ্টা করলাম “Knowing that you sleep, certain, safe, faithful channel of abandonment, pure line, so close to my manacled arms.”(আমি জানি হাল ছেড়ে নিশ্চিন্ত নিরাপদে তুমি ঘুমিয়ে আছো, আমার শৃংখলাবদ্ধ দুই বাহুর কাছাকাছি)।

শ্যাম্পনের ফেনিল শুভ্রতার ভেতর ডুবে থেকে আমি খেরার্দো দিয়েগোর সনেটটা বারবার আওড়াতে লাগলাম। তারপর আমার আসনটা পেছন দিকে নামিয়ে ওর সিটের সমতলে নিয়ে গেলাম। আমরা পাশাপাশি শুয়ে আছি। বাসরশয্যা হলে আমরা যতটা কাছাকাছি থাকতাম, এখন তার চেয়েও কাছে আছি।

গত বসন্তে আমি কাওয়াবাতার ‘হাউস অব দ্য স্লিপিং বিউটিজ’ বইটা পড়েছিলাম। সেখানে কিয়োটোর একটা মফস্বল শহরের অদ্ভুত এক বাড়ির কথা বলা হয়েছে যেখানে বয়স্ক বুর্জোয়া লোকেরা মোটা অংকের টাকা খরচ করে জীবনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ প্রেম উপভোগ করতে যায়। ওই বাড়িতে তারা শহরের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থেকে সারাটা রাত কাটিয়ে দেয়। মেয়েগুলো বিবস্ত্র অবস্থায় তাদের সাথে একই বিছানায় শুয়ে থাকে। তবে মেয়েগুলোকে জাগিয়ে তোলা এমনকি স্পর্শ করাও বারণ। তারা সেই চেষ্টা করেও না। কারণ তাদের জন্য সবচেয়ে গভীর আনন্দের ব্যাপার হলো বুড়ো বয়সে স্বপ্নের মতো এতগুলো রূপবতী নারীর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারা।

সেই রাতে আমি নিউইয়র্কগামী প্লেনে ঘুমন্ত সুন্দরীর পাশে বসে সেই অভিজ্ঞতার আস্বাদই গ্রহণ করছিলাম। আমি শুধু বার্ধক্যের পরিশুদ্ধতা নিয়ে পড়ে থাকিনি, আমি সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করেছিলাম ব্যাপারটা। শ্যাম্পেনের আমেজে মাথাটা হালকা হয়ে গেলে আমি মনে মনে নিজেকে বললাম, ‘কে জানতো আমি এই শেষ বয়সে এসে এক প্রাচীন জাপানীজে পরিণত হবো।’

অতঃপর আমি শ্যাম্পেনের কাছে পরাজিত হয়ে এবং পর্দায় দৃশ্যমান সিনেমার নিঃশব্দ স্ফুলিঙ্গের প্রভাবে কয়েক ঘন্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন জেগে উঠলাম আমার মাথাটা বনবন করছিল। বাথরুমে যাবার জন্য উঠতে হলো। আমার দুই সিট পরে সেই ১১ স্যুটকেসের বুড়িটা বেতাল হয়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে ভুলে ফেলে যাওয়া লাশের মতো। তার রঙিন পুঁতির মালায় আটকানো রিডিং গ্লাসটা মাঝের আইলে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি সেটা তুলে না দিয়ে কেমন একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলাম।

বাথরুমে অতিরিক্ত শ্যাম্পেনের চাপটা হালকা করার পর আমি আয়নায় নিজের দিকে তাকালাম। আমাকে দেখতে রীতিমত কিম্ভূত কুৎসিত লাগছিল। প্রেমে পড়ার প্রতিক্রিয়া যে এমন ভয়ানক হতে পারে ভেবে অবাক হয়ে গেলাম।

হঠাৎ করে কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়া প্লেনটা দুম করে উচ্চতা হারিয়ে নীচের নিকে নেমে গেল এবং পূর্ণ গতিতে চলতে লাগলো। সাথে সাথে ‘রিটার্ন টু ইওর সিট’ সাইনটা জ্বলে উঠল। আমি দ্রুতগতিতে আমার সিটে ফিরে যাবার জন্য ছুট লাগালাম। আমার আশা ছিল এই ঐশ্বরিক ঝাঁকুনিতে মেয়েটা জেগে উঠবে এবং হঠাৎ ভয় পেয়ে আমার দুই বাহুর মধ্যে আশ্রয় খুঁজবে। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে আমি সেই ডাচ বুড়ির চশমাটা প্রায় মাড়িয়েই দিচ্ছিলাম। মাড়িয়ে দিলেও আমি অখুশি হতাম না। তবু কী মনে করে আমি এক পা পিছিয়ে চশমাটা তুলে নিয়ে তার কোলের ওপর রেখে দিলাম। হঠাৎ করে তার প্রতি একটা কৃতজ্ঞবোধ হলো। কারণ তিনি আমার আগে থেকেও চার নম্বর আসনটা বেছে নেননি।

সিটে ফিরে গিয়ে দেখলাম রূপবতীর ঘুম ভাঙ্গেনি। তার ঘুমটা অপরাজেয়। প্লেনটা যখন স্থির হলো আমার খুব ইচ্ছে করছিল কোন একটা অজুহাতে ওকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলি। কারণ আমি চাইছিলাম অন্তত শেষ ঘন্টায় এসে মেয়েটা জেগে থাকুক। এমনকি মেয়েটা ক্ষেপে গেলেও আমার আপত্তি ছিল না। ওতে আমি মুক্তি পেতাম, এমনকি যৌবনও। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না। ব্যর্থতার জন্য নিজেকে নিজে শাপ শাপান্ত করে বললাম, ‘মরগে যা! কেন যে বৃষ রাশির জাতক হয়ে জন্মালি না!’

প্লেনটা নামার একটু আগে মেয়েটা নিজ থেকেই জেগে উঠলো। তাকে দেখে এমন তরতাজা সুন্দর দেখাচ্ছিল যেন সে একটা গোলাপের বাগানে এতক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছিল। ওকে দেখে বুঝতে পারলাম বহুকাল একসাথে সংসার করা পুরোনো দম্পতিদের মতো প্লেনের মধ্যে পাশাপাশি ঘুমিয়ে থাকা সহযাত্রীরাও ঘুম ভেঙ্গে ওঠার পর পরস্পরকে গুডমর্নিং বলে না। সেও বলল না। সে তার মাস্কটা খুলে দীপ্তিময় চোখ দুটো উন্মোচিত করলো। পেছনের সিটটা সোজা করল, কম্বলটা পাশে সরিয়ে রাখল এবং আপনাতে ঝরে পড়া কয়েকটা চুল ঝেড়ে ফেলে দিল। তারপর কসমেটিক্স বক্সটা হাঁটুর ওপর তুলে নিয়ে দ্রুতহাতে কিছু অপ্রয়োজনীয় মেকাপের কাজ সারল।

এসব করতে করতেই এত সময় লেগে গেল যে প্লেনের দরোজা খোলার আগ পর্যন্ত সে আমার দিকে তাকাবারও অবসর পেল না। তারপর সে তার লিংক্স জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে যখন উঠে যাবে তখন আমাকে প্রায় মাড়িয়ে দিচ্ছিল। সাথে সাথে অবশ্য বিশুদ্ধ ল্যাটিন আমেরিকান স্পেনিশে দুঃখপ্রকাশ করলো। তারপর প্রথম যাত্রী হিসেবে প্লেন থেকে গটগট করে নেমে গেল। যাবার সময় একটা গুডবাই পর্যন্ত বললো না। অন্তত একটা ধন্যবাদ দিতে পারতো আমাদের দুজনের একটা সুখী নিরুপদ্রব রাত একসঙ্গে কাটাবার স্বার্থে আমি যা কিছু করেছি সেজন্য। কিন্তু সে একটা শব্দও উচ্চারণ না করে হেঁটে বেরিয়ে গেল নিউইয়র্কের আমাজন জঙ্গলের রোদের মধ্যে।
---------------------------------

মূল গল্প: Gabriel Garcia Marquez লিখিত Sleeping Beauty and the Airplane
Edith Grossman এর ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

অনুবাদ চমৎকার হয়েছে।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ তিথী!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

Aisleকে চাইলে বাংলায় একেবারে দেশি 'আইল'ও বলা যায়, উচ্চারণ আর অর্থ একই রেখে, চিন্তা করে মজা পেলাম।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আমি যেহেতু আদা ও জাহাজের কারবার দুটোই করি, তাই বাংলা আইল শব্দটা ইংরেজিতে রপ্তানী করতে পেরে আমি বিমলানন্দ পেয়েছি হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

৪। খুব ভালো গল্পের অতি কুৎসিত বঙ্গানুবাদ পড়ার অভিজ্ঞতা জীবনে এত বেশি হয়েছে যে বেশ কয়েক বছর আগে মনে মনে কানে ধরেছি। ঠিক করেছি তৃতীয় কোনো ভাষার সাহিত্যের ইংলিশ অনুবাদ সহজলভ্য হলে আর বঙ্গানুবাদ পড়ার চেষ্টা করব না। আমার সময়, শক্তি, অর্থ সবকিছুর টানাটানি আছে।

৩। কুৎসিত বঙ্গানুবাদ পড়ে রেগেমেগে নিজেই ভালো বঙ্গানুবাদ বা রূপান্তর করে ফেলাটা খুবই ভালো কাজ হয়েছে। একেবারে গুনে গুনে প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেলো। মাঝখান থেকে আমাদের মানে পাঠকদের লাভ হলো।

২। সোওল-ব্যাংকক রুটের গল্পের যে মূলো ঝুলিয়ে গেলেন সেটা শীঘ্রই নামান। এমন অভিজ্ঞতা তো আর গ্যাবোর পৈত্রিক সম্পত্তি না।

১। কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি'র যে সাহিত্যকর্মের রেফারেন্স এখানে দেয়া আছে সেটা কয়েক রাতের ঘুম দূর করার জন্য যথেষ্ট।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

৪. আমার অনুবাদ ভীতি তৈরি হয়েছে সেবা প্রকাশনীর যুগ পার হয়ে আসার পর থেকে। না বুঝে একসময় প্রচুর অনুবাদ কিনে পড়ে অর্থ সময়ের বিপুল অপচয় করেছি। পরে বুদ্ধিমান হয়েছি। আপনি যে সাহস করে অনুবাদ গল্পটা পড়েছেন, সেটার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা।

৩. গুনে গুনে প্রতিশোধ.....শুনে হেসে ফেললাম। অমন কঠোর কোন ব্যবস্থা নয়। উনি শব্দার্থ অনুবাদ করে পাশাপাশি সাজিয়ে গেছেন। বাক্যটা শুদ্ধ হয়েছে কিনা সেটাও খেয়াল করেননি। সে কারণে বিরক্ত হয়েছিলাম। আমি নিজেও খুব ভালো অনুবাদ করি দাবী করবো না। কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে আক্ষরিক শব্দার্থের গোলমাল এড়িয়ে সহজবোধ্য শব্দ দিয়ে গল্পটা যেন পাঠক বোঝে সেই চেষ্টা করি।

২. মহাকাল সুযোগ দিলে সে অভিজ্ঞতার গল্পটা একদিন লিখে ফেলবো।

১. মার্কেজের কারণে নয়, আপনার রেফারেন্স পেয়ে কাওয়াবাতার বইটা পড়ার আগ্রহ জোরদার হলো।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নৈ ছৈ এর ছবি

এত ভাল লাগলো!

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ নৈ ছৈ!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বহুদিন আগে অমিতাভ রায়ের ভাষান্তরে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর গল্পসমগ্রটি কেনার পর সেটি একরকম অবহেলা অনাদরেই পাশে সেলফের এককোণে পড়ে ছিল। একদিন হঠাৎ সময় হলো হাতে তুলে নেবার। শুরুতেই একটি চমৎকার গল্প! বাংলা ভাষান্তরে ‘সুপ্ত সুন্দরী ও বিমান’ আর মূল স্প্যানিশে ‘El avión de la Bella Durmiente’। যাদু-বাস্তবতা, নাকি মার্কেসের বাস্তব জীবনেরই রোজনামচা।

গল্পে মার্কেস একজন প্রৌঢ়, বিমানের প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণ করছেন, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপে, যা মার্কেস প্রায়শই করতেন। গল্পের প্রৌঢ়টির সাথে মার্কেসের জীবনের অনেক মিল। তাই বিশদ বর্ণনায় গল্পটিতে বাস্তবের সাথে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এয়ারপোর্টে দেরী হওয়া, পথে নানাবিধ বিঘ্ন, সাত নম্বর সিটের বদলে চার নম্বর সিট পসন্দ করা, ‘তুমিই শুধু চার নম্বর পসন্দ করলে’, কাউন্টারের ভদ্রমহিলার একথা বলে উঠা, এসবের বিস্তারিত বর্ণনায় গল্পটি বাস্তবের অনুষঙ্গ হয়ে উঠে।

তবু কোথায় যেন গল্পটি একটি রূপকথার মতো, বিশেষত তাঁর শিরোনামটি, ‘ঘুমন্ত সুন্দরী...’, আহা!

মার্কেস যেন বাস্তবের সাথে স্বপ্নের মিশেল ঘটিয়েছেন, তাই কি মনে হয়, ‘বাস্তব কখনো কখনো কল্পনার চাইতেও অভিনব’? গল্পের আলোচ্যে কিছুটা ‘ভাগ্যে’র উপকরণ মিশে আছে, একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। গল্পের প্রৌঢ়টি বিমানবন্দরে সুন্দরী রমণীটিকে দেখতে পায়। তার কথা ভাবতে থাকে, মনে মনে তাকে কামনা করতে থাকে। তারপর সে সাত নম্বর সিটের বদলে চার নম্বর সিট পসন্দ করে। আর সবশেষে কাকতালীয়ভাবে সুন্দরীটির সিটের পাশেই তাঁর সিট পড়ে। তবু সৌভাগ্যের আনুকূল্য লাভের পরেও সুন্দরীটি অধরাই থেকে যায়। তাই মনে করি, গল্পের আলোচ্য বিষয় হলো, ‘অপ্রাপ্ত বাসনা’।

ওহে সুন্দরী, তুমি ঘুমন্ত, স্বপ্ন দেখছ হয়ত, অথবা তুমি নিজেই তো একটি স্বপ্নের মতো, কিংবা স্বপ্ন জাগানিয়া, নিখুঁত সুখের মতো, বড় পার্থিব। তবু তো তোমার বিচরণ এই বাস্তবে, দিবাস্বপ্নের পিলসুজে দীপাবলি জ্বালো, ঘুমন্ত গোলাপ কুঁড়ির মত, মনলোক স্পর্শ করো তবু থেকে যাও স্পর্শহীন।

তাই তো স্বপ্নই তুমি, নাকি সেটিই স্বপ্ন— যেটি আমি রচনা করি হৃদয়ের অতল গহনে?

আপনার অনুবাদ সুন্দর হয়েছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অনুবাদ পড়ে এত সুন্দর একটা তাৎপর্যময় মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ রোমেল ভাই।

ঘটনাটি সত্যি সত্যি মার্কেজের নিজের জীবন থেকে নেয়া। সেই ঘটনাটা আপনি 'স্ক্যাণ্ডাল অব দ্য সেঞ্চুরি' নামে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ সংকলনে পাবেন। গল্পের সাথে তাঁর সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার বিবরণে সামান্য পার্থক্য আছে শুধু। গল্পটিতে শেষ ভাগে মেয়েটা নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টে নেমে যায়। আর মার্কেজ মেক্সিকো সিটির ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে সিটে বসে থাকেন এবং পাশের সিটে মেয়েটার উষ্ণ উপস্থিতি অনুভব করতে থাকেন গন্তব্যে পৌঁছার আগ পর্যন্ত। সেখানে গিয়ে তিনি যা করেছিলেন সেটাও মজাদার ছিল। তিনি ইমিগ্রেশন ফরম পুরণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন- 'পেশা: জাপানী লেখক। বয়স: ৯২ বছর।'

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।