দাতো তুরাশভিলি’র জিনস জেনারেশন-৩

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১০/০৮/২০২০ - ১১:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বইয়ের দোকানের পরেরটি জুতোর দোকান। বাটার। বেশ বড় শোরুম। দাতো এবারে সে দোকানে ঢোকে। যদিও জুতো কেনার কোন ইচ্ছে আদৌ ওর আছে বলে মনে হয় না। লোকটার এই ভবঘুরে উদ্দেশ্যহীন ভাবটা বেশ লাগছে আমার। যেখানে ইচ্ছে হচ্ছে, থামছে। পথচলতি ভক্তদের সাথে থেমে কথা কইছে। তরুণী ভক্তদের গালে ঠকাস ঠকাস করে চুমু খাচ্ছে। দোকানে ঢুকে দোকানীদের সাথে ঠাট্টা মশকরা করছে। এই বাটার দোকানেও তেমনই ঘটলো। ফিরে আসার সময়ে খুব গম্ভীর একখানা মুখ নিয়ে বিক্রয়কর্মী মেয়েটিকে বলল, ‘জুতো কেনার পুরো ইচ্ছে কিন্তু আমার ছিল। কিন্তু কী করবো বলুন, আপনারা তো রেখেছেন সব তুর্কি ধাঁচের জুতোর মডেল। তুর্কিদের যেহেতু পছন্দ করি না, তাই ওদের জুতোর মডেলও পছন্দ করি না।’ মেয়েটি হেসে খুন। এদেশের ওরা তুর্কিদের খুব একটা পছন্দ করে না। কারণ, শত শত বছর ধরে তুর্কিদের হাতে দেশটি বহুবার আক্রমণের মুখে পড়েছে। তুর্কিদের নিয়ে তাই নানা রকমের ব্যাঙ্গাত্মক কৌতুক ওদের মাঝে জনপ্রিয়।

সেদিন রাতে পথ হাঁটতে হাঁটতে জেনেছিলাম, লেখালেখির পাশপাশি টাকার টান পড়লে দাতো মাঝে-সাঝে টুরিস্টদের নিয়েও এদিক-সেদিক যায়। তাই জর্জিয়ার নানা স্থান আর ইতিহাস একেবারে ওর নখদর্পণে। সেসবের সূত্র ধরেই ও বলছিল একখানা বাড়ির গল্প। সেটি এই শহরেই। স্তালিনের জমানায়, বিশেষত ত্রিশের দশকে, এ শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পুরনো বাড়িগুলোকে ভেঙে নতুনভাবে শহরের রূপ পত্তন করা হয়েছিল। সড়ক বর্ধিতকরণের সময়ে যেমন করে কাটা পড়ে শতবর্ষী বট, তেমনি করে সেই নতুন ভিন্ন ধারার স্তাপত্য-স্রোতে ভেসে যায় ইতিহাসকে আঁকড়ে থাকা কাঠের দোচালা ইমারত। নেহায়াতই ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় একটি বিশেষ বাড়ি। বাড়ির মালিকের জামাতা ছিলেন স্তালিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তিনিই শ্বশুর মশাইয়ের হয়ে তদবির করে বাড়িয়ে দেন বাড়িটির আয়ুষ্কাল।

বিজ্ঞান একাডেমীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাতো-র জন্যে অপেক্ষা করি। সামনেই বাসস্ট্যান্ড। দু পাঁচ মিনিট পর পর বাস আসছে। শুধু নীল আর হলুদ– এ দু রঙের বাস চলে সারা শহরে। নীল রঙের গুলো একটু দূরপাল্লার। শহর ছাড়িয়ে ওগুলো যায় শহরতলীতে। আর হলুদ বাসগুলো চলে এপাড়া-ওপাড়ায়। গরীব দেশ হলেও সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্য নেই; নেই যাত্রীদের পকেট কাটার ব্যবস্থা। এইতো সেদিন শহরের কেন্দ্র থেকে নীল বাসে করে বিমানবন্দরে গেলাম। বেশ আধুনিক বাস। দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। ভাড়া নিল মাত্র পঞ্চাশ পয়সা। আমাদের টাকায়– মাত্র পনের টাকা। ওদের বাসগুলোর সাথে ঢাকার লক্কড়-ঝক্কর বাসগুলোর একটা তুলনামূলক চিত্র যখন মনে মনে ভাবছি, তখন দেখি দাতো হন্তদন্ত হয়ে রাস্তা পেরিয়ে এদিকে আসছে।

‘এখানে আসবার পথে এক ক্রিসমাস ট্রি-র দোকানে আটকে পড়েছিলাম। মায়ের জন্যে কেনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মন মতো পেলাম না। তুমি কি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছ?’– তারপর জবাবের অপেক্ষা না করেই ‘এসো, এদিকে এসো’ বলে আমাকে বিজ্ঞান একাডেমীর বারান্দার মাঝ দিয়ে পেছনের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ করে। ওদিকটায় কয়েকটি রুগ্ন জীর্ণ বাড়ি। একটি বাড়ির সিঁড়ির প্রান্তদেশে বসে খাতায় চোখ বুলাচ্ছে এক তরুণী। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ওই বাড়িটির পাশেই উইলোর ঝোপে ঢাকা একটি পথ। পথের ডানে ধাতব বেষ্টনী ঘেরা এক টুকরো চৌকোণা জমি। সেখানে ফ্রি স্টাইলে হেঁটে বেড়াচ্ছে দানবীয় শরীরের এক জার্মান শেফার্ড কুকুর। আমাদের দেখে কুকুরটি বেড়ার কাছে এসে সন্দিগ্ধভাবে তাকায়। তবে খামোখা ঘেউ ঘেউ করে পাড়া মাথায় তোলার মতো ন্যাক্কারজনক কাণ্ড ঘটায় না। হয়তো ও বুঝতে পারে, আমরা বহিরাগত হলেও চোর-ছ্যাঁচড় নই। এই প্রাণময় পাহারাদারটিকে উপেক্ষা করে সামনে এগুতেই ভেসে ওঠে সেই নীল রঙের দ্বিতল ভবনটি। বারান্দার রেলিং, জানালার কার্নিশ, ছাদের প্রান্ত– সবখানেই ছুতার মিস্তিরির মুনশিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। বাড়িটির ভেতরের উঠোনেও ঢোকা যায়। সেখানে গিয়ে বুঝি, আজকাল এখানে হয়তো কিছু কম পয়সার ভাড়াটিয়া বাসা বেঁধেছে। তাদের একজন সেই মুহূর্তে বারান্দায় রেলিং-এ রোদে দেয়া কম্বল তুলতে এসে আমাদের দিকে অবাক চোখে তাকায়।

পার্লামেন্ট নামক যে ক্যাফেটিতে দাতো আজ আমাকে নিয়ে চলেছে, সেটি মেরাব কস্তাভা স্ট্রিটের এক কোণে। যাবার পথে ফিলহারমনিক নামক স্টেট থিয়েটারের গোলাকার ভবনটিকে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। ৭১ সালে নির্মিত এই ভবনটির সামনে নৃত্যের ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান এক নারীর ভাস্কর্য। আজ ওখান দিয়ে যাবার সময়ে দেখলাম, উল্টোদিকে পার্কের এককোণে প্রশস্ত ফুটপাথে থেমে রয়েছে একটি মাইক্রোবাস। তাকে ঘিরে ছোটখাটো জটলা। ওটি আসলে ভ্রাম্যমাণ ব্যাংক। অফিসফেরত লোকেরা বাড়ি যাবার পথে ব্যাংকের কিছু কাজ এই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই সেরে নেয়। এই জটলাকে পেছনে ফেলে বাঁ ধারে চেজ ফেডারেশনের ভবনটিকে রেখে হাঁটলেই সেই ক্যাফে পাড়া।

ক্যাফে পাড়া বলছি, কারণ ওদিকটায় এক গলিতেই প্রায় ছ সাতটি ক্যাফে। এমন নয় যে খুব ব্যস্ত পাড়া। তবুও হটাৎ সেখানেই এতগুলো ক্যাফের সমাহার কেন? সেদিন একজন বলছিল, এ শহরে কেও কোথাও দোকান খুলে লাভের মুখ দেখলে তাকে দেখাদেখি রাতারাতি আরও কিছু লোক ওই একই এলাকায় একই দোকান খুলে বসে। ফলে যা হবার, সেটাই ঘটে। লাভের মুখ দেখা সেই প্রথম দোকানটিসহ বাকি সবাই অল্প কিছুদিনের মাঝেই লালবাতি জ্বালিয়ে কেটে পড়ে।

পার্লামেন্ট ক্যাফের মালিক তরুণ বয়েসি এক ভদ্রলোক। বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখে বেশ খাতির করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ঢুকেই বুঝলাম, খুব সম্প্রতি ক্যাফেটিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। ঢোকার মুখে ডান দিকের দেয়ালে টাইম ম্যাগাজিনের একটি কভার ফ্রেমে বাঁধানো। এক ভদ্রলোক লেক জেনেভার ধারে খুব আয়েসি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন, এই হল সেই কভারের চিত্র। আমি টাইম ম্যাগাজিনের নিয়মিত গ্রাহক। কিন্তু এমন কোনো কভার গত দশ বছরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। রহস্যটা পরিষ্কার হল খানিক বাদেই।

ভেতরে তখনও জমে ওঠেনি। ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে দাতো-র ভক্তকুলকে আজকের এই আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারা সবে আসতে শুরু করেছে। আরও মিনিট পনের বাদে হয়তো মূল আলোচনা শুরু হবে। মাঝের সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ক্যাফে মালিক দাতো-র হাতে তুলে দিলেন দু বোতল ওয়াইনের একটি প্যাকেট। উপহার। তার থেকে এক বোতল বার করে কাঠের টেবিলে রাখা হয়। ইংরেজিতে লেখা লেবেলটি আমার দিকে মুখ করে থাকায় আমি ঝট করে পড়ে নিই। রুস্তাভেলি ব্র্যান্ডের ওয়াইন। তার নিচে লেখা– উশাখেলাউরি। ‘নাও, এই হল জর্জিয়ার সবচেয়ে দামি ওয়াইন’– দুটো পানপাত্র চেয়ে নিয়ে লালচে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে দাতো বলে। আমার দিকে একটি গ্লাস এগিয়ে তারপর যোগ করে, ‘জর্জিয়ার মাত্র একটি গ্রামেই এই ওয়াইন হয়। ওখানকার আঙুরগুলো ভিন্ন স্বাদের। সেজন্যেই এমন আগুন দাম। এই এক বোতল…প্রায় ৭০০ লারি দাম। ভাবতে পারো?’– তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এদের এখানে এলেম বলেই না এ জিনিস চাখতে পারলাম। ভালোই করেছি এসে, কি বল?’ একটু মিষ্টি স্বাদের সেই মহামূল্য ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে আমি মৃদু হেসে মাথা দোলাই।

দাতো ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে দু একজনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাকে একা বসে থাকতে দেখে সেই মালিক ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন। তারপর শুদ্ধ ইংরেজিতে বলেন, ‘দাতো-র কাছে শুনলাম, আপনি নাকি আমেরিকা নিবাসী? আমিও একসময় আমেরিকায় ছিলাম। এরিজোনায়। বেশি দিনের জন্যে নয় অবশ্য। এই এক বছরের জন্যে। ফিরে এসে এই ব্যবসায় নামলাম। তা আপনি কোন শহরে থাকেন?’ ততক্ষণে আমার নজর গেছে উল্টোদিকের দেয়ালে ঝুলানো ‘কিসিং স্ট্যাচু’ ছবিটির দিকে। সেই বিশেষ ছবিটির দিকে নির্দেশ করে বলি, ‘এই স্ট্যাচুটি যে শহরে, সেখানে।’ যুবকের মুখ খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘আরে, তাই নাকি? আমি সান ডিয়েগোতে একবার গিয়েছি তো। খুব সুন্দর শহর।’– তার আমেরিকা-সংক্রান্ত স্মৃতি রোমন্থনে বাধা দিয়ে বলি, ‘আচ্ছা ওদিককার ওই টাইম ম্যাগাজিনের কভারটি আপনি কোথায় পেয়েছেন বলুন তো? ওই সংখ্যাটি তো এর আগে দেখেছি বলে মনে হয় না।’ আমার কথায় যুবক হেসে ওঠে। তারপর আমাকে হাতের ইশারায় ছবিটির কাছে আসতে বলে। সেখানে দাঁড়িয়ে তার কাছ থেকে এই ক্যাফে আর এই ছবির যে গুপ্তকথা জানতে পারি তা অনেকটা এমন–

উদ্বোধনের স্বল্পকালের মাঝেই এই ক্যাফেটি ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে সরকারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম জমায়েতস্থল হিসেবে। জর্জিয়া এই মুহূর্তে পার করছে এক ক্রান্তিকাল। বর্তমান সরকারের আগে যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি ছিলেন কট্টর রুশ বিরোধী। তিনি জর্জিয়ার অর্থনীতিকে অনেকটাই খাদের কাছ থেকে টেনে তোলেন। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন সরকারের নানা সংগঠনে। অবকাঠামো খাতে প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন। ক্ষেত্র বিশেষে দুর্নীতিও কমান। এইতো সেদিন মাঝরাতে এয়ারপোর্ট থেকে শহরে আসার পথে ট্যাক্সির চালক বলছিল, বছর দশেক আগে এলে দেখতে চেকপোস্টের পুলিশরা গাড়ি থামিয়ে আমার কাছে ঘুষ চাইছে। কিন্তু গত প্রেসিডেন্টের আমল থেকে পুলিশের এই ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে।– এমন বহু সাফল্যই ছিল আগেকার প্রেসিডেন্টের ঝুড়িতে। তবে এতোসব সফলতা তাকে এক পর্যায়ে স্বেচ্ছাচারীতে পরিণত করে। তিনি ভাবতে থাকেন, দেশের সকল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তিনি-ই। একটা উদাহরণ পেলাম এ সম্বন্ধে। জর্জিয়ান এক বিখ্যাত গায়িকা ইউরো ভিশন সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় গাইতে যাবেন। প্রেসিডেন্ট তাকে নির্দেশ পাঠালেন– তোমাকে অমুক রঙের পোশাক পরে গাইতে হবে। সবাই বিস্ময়ে হতবাক।

এসব কারণেই জর্জিয়ার উন্নয়নে ব্যাপক কৃতিত্ব থাকলেও পরের নির্বাচনে তিনি আর পেরে উঠলেন না। নির্বাচিত হলেন বিরোধী দলের নেতা। ইনি আবার একটু রুশ ঘেঁষা। অন্যদিকে ব্যাপক দুর্নীতিবাজ। অযোগ্য-ও বটে। দেশ এগিয়ে নেবার মত দূরদর্শী তিনি নন। ফলে জনগণ খুব তাড়াতাড়ি তার উপর থেকেই আস্থা হারিয়ে ফেলে। তারপরও চলছিল। কিন্তু মাস কয়েক আগে এমন একটি ঘটনা তিনি ঘটান, যার ফলে সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তরুণরা নেমে আসে রাজপথে, তাঁবু টানিয়ে অবস্থান নেয় সংসদের সামনে। ঘটনাটি ছিল– প্রেসিডেন্ট একজন গুরুত্বপূর্ণ রুশ নেতাকে ওদের সংসদে ভাষণ দেবার আমন্ত্রণ জানান। এটা জনগণ মানতে পারেনি। তাঁদের কথা হল, যে রাশিয়া আমাদেরকে এখনো পদাবনত করে রাখতে চায়, যে রাশিয়া গায়ের জোরে আমাদের ভূমি দখল করে বসে আছে, তাদের সাথে এতো সখ্যতা কেন? আরও গোল বাধে যখন সংসদের সামনে জড়ো হওয়া সমাবেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে বসে। শোনা যায়, প্রেসিডেন্ট তখন রাজধানী থেকে মেলা দূরে এক শৈল নিবাসে বসে আরামসে হাওয়া খাচ্ছিলেন। সেই আক্রোশ থেকেই তরুণরা সেই ব্যাঙ্গাত্বক টাইম ম্যাগাজিন কাভার ছাপিয়ে বিলিয়ে দেয়, যেখানে লেখা– প্রেসিডেন্ট এখন লেক জেনেভায় ছুটিতে আছেন, বিরক্ত করবেন না।

তাহলে মুক্তি কোথায়? বোঝা যাচ্ছে, দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের উপর থেকেই মানুষ ভরসা হারিয়েছে। ওদিকে রাশিয়াকে নিয়ে সাম্প্রতিক যে অসন্তোষ, সেখানেও আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। এখানকার মুদি দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে বুঝেছি– সূর্যমুখী ফুলের তেল থেকে শুরু করে বিস্কুট, সবই আমদানি করে আনতে হয় রাশিয়া থেকে। ওদিকে এদের প্রধান রপ্তানি পণ্য ওয়াইনের একটা বড় বাজার রাশিয়ায়। রাশিয়ার সাথে তাই তুমুল বৈরিতা করে খুব বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। দূর থেকে আমেরিকা আর ইউরোপ নানা আশার বাণী শোনালেও ভৌগোলিকভাবে তারা নিকটে নয়। ফলে চাইলেও তারা জর্জিয়ার রুশ-নির্ভরতা কমাতে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাহলে এই আন্দোলন, এই জনরোষ কোনো শুভ ফল আদৌ বয়ে আনবে কি?

আমার প্রশ্নে ক্যাফে মালিক কিছুক্ষণ দুম মেরে বসে থাকে। তারপর কিছুটা বিষণ্ণ মুখে বলে, ‘ওয়েল, আমরা রাশিয়ার সাথে সম্মানজনক সম্পর্ক চাই, কিন্তু সেটা নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে নয়। এটা সত্যি, দেশটাকে সামনে এগিয়ে নেবার মত কোন জুতসই কাণ্ডারি এই মুহূর্তে আমাদের সামনে নেই। কিন্তু তাই বলে মুখ বুজে ঘরে বসে থাকবার জাতি আমরা নয়। আন্দোলন চালিয়ে যাব, দেখা যাক…। হয়তো এই আন্দোলনের মাঝ থেকেই একদিন বেরিয়ে আসবে নতুন প্রজন্মের নতুন কোনো নেতা, যিনি আমাদেরকে পথ দেখাবেন। সেই আশাতেই বসে আছি আপাতত।’

ক্যাফে মালিকের সাথে আলাপচারিতার এই পর্যায়ে শুনতে পাই দাতো চেঁচিয়ে বলছে, ‘সবাই মনে হয় এসে গেছে, এবার তাহলে শুরু করা যাক!’ ক্যাফে মালিক উঠে গিয়ে শ্রোতাদের সারিতে একটি চেয়ার দখল করে বসেন। শুরু হয় এক প্রাণবন্ত গ্রন্থালোচনা।

আলোচনাটি দাতো চালিয়ে যায় জর্জিয়ানে। শ্রোতাদের কথা মাথা রেখেই বোধ করি। আমার জন্যে তাই কিছুক্ষণ বাদেই হাই তোলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। সময় কাটাবার জন্যে ক্যাফের মূল্যতালিকার চক বোর্ডটির দিকে তাকাই। হুইস্কি, রাম, টেকিলা, জিন– এমন কিছু চেনা নামের পানীয়ের সাথে খাতসিতেলি, সুপারাভি, কিন্দযমারাউলি নামক কিছু স্থানীয় পানীয়ের নামও চোখে পড়ে। সেই সাথে আরও দুটো স্থানীয় পানীয়ের নাম চোখে পড়ে, যেগুলোর সাথে আমি পূর্ব পরিচিত। বাকুরানি, বরজমি– এরা কোনো হার্ড ড্রিংকস নয়, বরং কার্বোনেটেড ওয়াটার। মূল্য– প্রতি বোতল দু লারি। আমেরিকায় লেবানিজ দোকানে এই জলের বোতল ধুমসে বিক্রি হয়। তখনও জানতাম না এই বোতলের আদি উৎসস্থল কোথায়। এদেশে এসে জানলাম, এই বাকুরানি আর বরজমি হল জর্জিয়ার দুটো বিখ্যাত শৈলশহর। সেখানে প্রকৃতি-ই উদার হাতে মানুষের তৃষিত গলায় ঢেলে দেয় ভিন্ন স্বাদের ঝাঁঝালো জল। সরাসরি সেখানকার প্রসবনগুলো থেকে বোতলে ভরে সেই জল পৌঁছে যায় রাজধানী পেরিয়ে আটলান্টিক পাড়ের ভিন্ন কোনো শহরে।

কাউন্টারের পেছনে থাকা মেয়েটি টেবিলে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে দাতো’র বক্তৃতা শুনছে। আমি গিয়ে এক মগ বিয়ার অর্ডার করলে সে ঝটপট ডিসপেনসার থেকে বিয়ার ঢেলে আবারও মনযোগী শ্রোতার দলে নাম লেখায়।

আমি বিয়ারের মগটি নিয়ে নিঃশব্দ বেড়ালের মত ক্যাফের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসি। শীত জমে ওঠায় পথে লোকজন কম। মগটি বেশ ভারী হওয়ায় জানালার ফ্রেমে সেটি রেখে খানিকটা দম নিই। ‘ভেতরে বোর হচ্ছিলে বুঝি?’– একেবারে পেছনের সারিতে বসে থাকা এই মেয়েটি হয়তো বাইরে এসেছে সিগারেটে আগুন ধরাতে। ‘ইচ্ছে ছিল তোমাদের কথাগুলো শুনবার। মনে হল, তোমরা অনেকেই নানা প্রশ্ন করছ দাতো-কে। সোভিয়েত সময়ের উত্তাল দিনগুলো নিয়ে। কৌতূহল হচ্ছে পুরোটা জানবার। দেখি, পরে এক সময়ে দাতো-কে বলব আজকের আলোচনাটার সারাংশ আমাকে ইংরিজিতে বলতে।’ সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে মেয়েটি বলে, ‘আমার অবশ্য ও নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই। সেজন্যেই সিগারেট টানতে বাইরে এলাম। অতীত নিয়ে গবেষণা করাটা আমার কাছে একপ্রকার বিলাসিতা বলে মনে হয়। বর্তমানটাই যেখানে বড্ড ঘোলাটে, সেখানে এই অতীতের কচকচানি শুনে আমি কি করবো? এই তো কয়েক মাস আগে পার্লামেন্টের সামনে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার বয়ফ্রেন্ড প্রায় বিশটি রাবার বুলেট খেল। এখনো ও ব্যাথায় কাতরায়, সেই গুলির যন্ত্রণায়। এই অপদার্থ সরকারকে না হটানো পর্যন্ত…– এটুকু বলে ও অলক্ষ্যে ছাইদানি খোঁজে। কিন্তু এখানে আর সেটি পাবে কোথায়? অগত্যা তাই বাষ্পহীন ভারী বাতাসে সিগারেটের অগ্রভাগে জমে থাকা ছাইগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘যাকগে, বাদ দাও। আমাদের এতোসব হতাশার কথা শুনে তুমিই বা কী করবে?’

খানিকটা ছটফটে ধরণের এই মেয়েটি সিগারেট শেষ হওয়ামাত্র ‘ঘামে শিদভিচি’ অর্থাৎ শুভ রাত্রি বলে বাঁ দিকের অন্ধকার পথটির মাঝে হারিয়ে যায়। আমি ওর প্রস্থান পথের দিকে তাকিয়ে ভাবি– আরে, মেয়েটির নামই তো জিজ্ঞেস করা হল না। হল না জানা সরকার-বিরোধী আন্দোলনে ওর ব্যাক্তিগত ভূমিকার কথা। তবে এই ক্যাফেটি মনে হচ্ছে ওদের নিয়মিত আড্ডার ঠেক। সেক্ষেত্রে কাল-পরশু যদি এই একই সময়ে এখানে ঢুঁ মারি, তবে ওর সাথে আবারও দেখা হতে পারে কি? তেমনটি হলে হয়তো আমার জন্যে মিলতে পারে আরও কিছু গল্পের রসদ।

এসব কিছু ভাবার মাঝেই খেয়াল করি, ঘড়ির কাটা এসে থেমেছে রাত দশটার ঘরে। এবারে তো তাহলে আমাকেও প্রস্থানের কথা ভাবতে হয়। ওদিকে দাতো’র সভা মনে হয় আরও কিছুক্ষণ চলবে। সেটি শেষ হবার আগেই চুপি চুপি ভেগে গেলে ব্যাপারটা সৌজন্যবোধের সীমানা অতিক্রম করবে কি? হাজার হোক, ওর আমন্ত্রণেই তো এখানে আসা। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

অগত্যা বিয়ারের মগে প্রলম্বিত চুমুক দিয়ে দিয়ে সময়টাকে অতিক্রম করার চেষ্টা চালাই।

আগের দুটি পর্বের লিংকঃ
দাতো তুরাশভিলি’র জিনস জেনারেশন-২

দাতো তুরাশভিলি’র জিনস জেনারেশন-১


মন্তব্য

নৈ ছৈ এর ছবি

খুব ভাল লাগছে পড়তে

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে

চিহুয়াহুয়া এর ছবি

সুখপাঠ্য লেখা, আরো পর্ব আসুক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

পড়ছি।
ভালো লাগছে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

সময় নিয়ে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ

সোহেল ইমাম এর ছবি

সেইরকম ঈর্ষনীয় লেখনী একবার পড়তে শুরু করলে আর থামা যায়না। অনেকদিন ধরে দেখছি আপনার লেখাটা সময় করে উঠতে পারছিলামনা। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে চোখ বুলিয়েছি কেবল “জীবনযুদ্ধ” দেখেই মনের খাতায় লিখে রেখেছিলোম পড়ার মত লেখা কয়েকটা জমে আছে, পড়ে ফেলতে হবে। ভালো থাকবেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

রাজার্ষি এর ছবি

অনেক সুন্দর লিখেছেন।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।