সহজিয়া রামায়ণ ৩

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: সোম, ০৯/১০/২০১৭ - ৭:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সবকিছুতে সকলের অপমান হয় না। অপমানিত হইবার জন্য যে সামান্য পূর্বমান থাকা লাগে সেইটা দশরথের নাই; থাকলে বিশ্বামিত্র যা ঘটাইলেন তাতে রাজা দশরথের আগুন হইয়া উঠবার কথা…

দশরথের দুই পোলার বিবাহ আয়োজন কইরা দশরথরেই সেই বিবাহ খাইতে খবর দিলেন বিশ্বামিত্র- আপনের দুই পোলার বিবাহে আপনার নিমন্ত্রণ…

বিশ্বামিত্রের এই কাণ্ডে নিজের মান বাঁচাইতে জ্বইলা উঠা রাগেরে কৃতজ্ঞতায় রূপান্তর কইরা নিজস্ব মানুষদের দশরথ কন- ঋষি বিশ্বামিত্র যা করছেন তা পোলাগো লগে আমারো কপাল। কপালে সাত জন্মের পুন্য না থাকলে তিনার মতো মহান মানুষের দ্বারা এমন শুভকামের সিদ্ধান্ত হইবার কথা না; তৈয়ারি করো সকলে; ঢাকঢোল পিটাইয়া আমরা বরযাত্রী যাব…

দশরথ বিশ্বামিত্ররে এমন তেলানোয় পুরোহিত বশিষ্ঠ তলে তলে ফুইলা উঠলেও বুদ্ধির ব্যবহার করেন। বিশ্বামিত্র রাজবাড়ি আইসা রাম আর লক্ষ্মণরে যজ্ঞের জমি দখলের লাইগা নিয়া যাইবার আব্দার ধরলে আপদ খেদাইতে বশিষ্ঠও রাজা দশরথের কাছে সুপারিশ করেন। কারণ বিশ্বামিত্র যত বেশিক্ষণ রাজবাড়ি থাকবেন তত বেশি ঘিরিঙ্গির আশঙ্কা বশিষ্ঠের। তার চাইতে রাজার ভবিষ্যতহীন দুই পোলারে বিশ্বামিত্রের লগে বনে বাদাড়ে খেদাইতে পারলে বশিষ্ঠেরই সুবিধা…

এখন বিশ্বামিত্র নিজের কাম শেষ কইরা রাম লক্ষ্মণের বিবাহের আয়োজন কইরা পোলার বাপেরে নিমন্ত্রণ দিছেন বিবাহে সামিল হইতে। যেনতেন বিবাহ হইলে আপত্তি তোলা যাইত; কিন্তু রাম আর লক্ষ্মণের লাইগা তিনি বিবাহ ঠিক করছেন জনক রাজা সীরধ্বজের দুই মাইয়ার লগে…

এখন পোলাগো বাপেরে তিনি কেমনে বিবাহে যাইতে নিষেধ করেন? আবার রাজা যেই বিবাহে যাবেন সেই বিবাহে রাজপুরোহিতই বা না গিয়া কেমনে থাকেন?
তো বশিষ্ঠও রওনা দেন বর বিহীন বরযাত্রী দলে। রাজার বাকি দুই পোলা ভরত আর শত্রুঘ্নও চলে অন্য দুই ভাইর বিবাহে…

কিন্তু বিবাহের আসরে সবাইরে বেকুব বানায়া আরেকটা চাল চাইলা বসেন বিশ্বামিত্র। রাম লক্ষ্মণের বিবাহের আনুষ্ঠানিকতার মাঝখানে কাউরে না জিগায়া ভরত আর শত্রুঘ্নর বিবাহও আয়োজন কইরা ফালান তিনি। দশরথ পদের রাজা হইলে এই কাণ্ড ঘটাইবার সাহস হইত না বিশ্বামিত্রের…

কিন্তু দশরথ অতি ছোটমোট রাজা। আট মন্ত্রী আর পুরোহিত বশিষ্ঠ-বামদেব নিয়া নিজেরে স্বাধীন ভাবলেও রাজ্যের কার্যকর সীমা হাজার তিনেক বর্গকিলো ছাড়ায় না। এমন পুচকা রাজার পোলার বিবাহের সিন্ধান্ত নিতে দশরথরে বিশ্বামিত্রের না জিগাইবারই কথা…

এইদিকে বশিষ্ঠ বোঝেন; বিশ্বামিত্র চাইলে কী করতে পারেন তার কিছু নমুনা তিনি দেখাইতেছেন। আর পোলাগো বাপের যেইখানে কোনো আপত্তি নাই সেইখানে ভরা সভায় রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ কেমনে আপত্তি করেন?

বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্র; এই দুই বামুন গোত্রের মাঝে বংশ ধইরা বহুত পুরানা বিরোধ। বশিষ্ঠরা মূলত পুরোহিত কিন্তু যুদ্ধও পরিচালনা করেন; অন্যদিকে বিশ্বামিত্ররা মূলত যোদ্ধা কিন্তু পুরোতগিরিও করেন…

এই দুই গোত্রের মারামারির সূত্রপাত কোনো এক কালে এক রাজা সুদাস তার পুরোহিত বিশ্বামিত্র বামুনের চাকরি খাইয়া বশিষ্ঠ বামুনরে নিয়োগ দেওয়া থাইকা। সেইটা আইজ পর্যন্ত চলতে আছে…

বশিষ্ঠ স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নাই এমন ধরা খাবেন। বিশ্বামিত্র রাজার মাইয়ার লগে রামের বিবাহ না হয় দিলো; কিন্তু সেই একই রাজ্যের সেনাপতি কুশধ্বজের মাইয়ার লগে বিবাহ ঠিক কইরা ফালাইল ভরতের…

এইটা অনুমান করতে পারলে দশরথের লগে কোনোভাবেই ভরতরে আনতে দিতেন না তিনি; কারণ ভরতের সুবিধা অসুবিধা দেখা তার দায়িত্বের ভিতরেই পড়ে…

এই দিকে বিশ্বামিত্রের উপর রাগতে রাগতে একটা সম্ভাবনায় চোখ ঝিলিক দিয়া উঠে দশরথের- সত্যিই তো এইটা একটা আশীর্বাদ। নিজে ছোট রাজার পোলা আছিলেন দেইখা পয়লা বিবাহ কোনো রাজ পরিবারে করতে পারেন নাই; সাধারণ ঘরের মাইয়া কৌশল্যারে বিবাহ কইরা শুরু করতে হইছে সংসার। সেই ঘরে মাইয়া শান্তার জন্ম হইলে তারও বিবাহ হয় নাই কোনো রাজপুত্রের সাথে; বিবাহ হইছে এক পুরোহিতের লগে। সেইখানে বিশ্বামিত্রের আশীর্বাদে তার বড়ো পোলা জনক রাজবংশীয় মিথিলা রাজ সীরধ্বজের বড়ো মাইয়ার জামাই…

সব থাইকা বড়ো কথা রাম লক্ষ্মণের বিবাহ আসরে আকস্মিক সেনাপতির মাইয়াগো লগে ভরত শত্রুঘ্নর বিবাহ ঠিক কইরা বিশ্বামিত্র একখান নতুন সমীকরণ টাইনা দিছেন দশরথের সামনে…

রাজকইন্যার স্বামী রাজা হইব আর সেনাপতির জামাতা ভবিষ্যতে সেনাপতি হইতে পারলেই খুশি থাকবার কথা; দশরথের মনের চিন্তারে পরিষ্কার একটা ধাপ আগাইয়া দিয়া গেছেন বিশ্বামিত্র…

বিবাহের আসরে পর্যন্ত মনে মনে বিশ্বামিত্রের উপর নাখোশই আছিলেন দশরথ। কিন্তু এখন দুই হাত কপালে তুইলা বিশ্বামিত্ররে একখান নমস্কার ঠোকেন- আপনে আমার বহুত উপকারই কইরা গেছেন ঋষি…

বিশ্বামিত্রের লগে যখন রাম বাড়ি ছাড়ে তখন সে আছিল মাত্র দশরথের এক ষোল বছরের পোলা। কিন্তু যখন ফিরা আসে তখন সে একাধারে রাজা জনকের জামাই; তড়কা-খেদানো রাজ্য বিস্তারকারী; পরশুরাম-হারানো বীর আর ঋষি গৌতমের সাংসারিক ঝামেলা মিটানো এক সাব্যস্তের সালিশদার…

চোখের সামনে বাইড়া ওঠা রামের ভিত্রে একলগে অতকিছু পাইয়া অযোধ্যার মানুষেরাও দুর্দান্ত খুশি। দশরথও। নামে মাত্র রাজ্যের যে অংশগুলা অযোধ্যার লগে আছে; এইবার সেইগুলাতে যেমন নিয়ন্ত্রণ আনা যাবে; তেমনি দরকার পড়লে বাড়ানো যাবে রাজ্যের সীমা…

সবচে বড়ো কথা কেকয় রাজার খবরদারি থাইকা অযোধ্যারে বাইর কইরা আনলে আনতে পারে রামের নতুন জনপ্রিয়তা…

যুবরাজ হিসাবে তবে রামেরই অভিষেক করাইতে হবে…

বিবাহের পরপরই বৌ নিয়া ভরত নানাবাড়ি গেছে। সাথে গেছে শত্রুঘ্নও। ভরত অযোধ্যার বাইরে থাকতেই রামের অভিষেক করে ফেলতে হবে; সিদ্ধান্ত নিয়া ফালান দশরথ। রামরে ডাইকা সেই সংবাদও তিনি জানাইয়া দেন। মন্ত্রী আর সচিবগো আয়োজন বুঝাইয়া দিয়া এইটাও বইলা দেন যেন কোনোভাবেই ভরতের নানাবাড়ি আর পোলাপানগো শ্বশুরবাড়ি এই সংবাদ না যায়; ভরতের মা কৈকেয়ীও যেন না শোনে কথাখান…

রাজা জনকরে সংবাদ দিলে ভালো হইত কিন্তু মিথিলায় অভিষেকের সংবাদ গেলে সেইটা ভরতের শ্বশুর কুশধ্বজও জাইনা যাবেন…

পোলাপানের জন্মের আগ থাইকাই ঠিক হইয়া আছে দশরথের পরে সিংহাসনে বসব কৈকেয়ীর পুত্র। এই সিদ্ধান্ত সকলেই জানে। এর লগে বড়ো পোলা ছোট পোলার অধিকারের সম্পর্ক নাই। অপুত্রক দশরথের লগে এই শর্তেই নিজের মাইয়া কৈকেয়ীরে বিবাহ দিছিলেন কেকয় রাজা অশ্বপতি…

অশ্বপতির শর্তে দশরথ রাজি হইছিলেন দুইটা কারণে; এক বাপের এক পুত তিনি। কোথাও সহায় নাই; তার উপরে ছোটমোট একটা রাজ্য। এই দিকে ভয় তো সেই দিকে ভয়…

অশ্বপাতির মাইয়া বিবাহ করলে অন্তত কিছু শক্তি পাওয়া যাবে। আর সাধারণ ঘরের বিবির পোলারে বাদ দিয়া রাজকন্যার পোলারে পরে রাজা করতেই বা অসুবিধা কী?

রাজি হইছিলেন দশরথ। রাজা অশ্বপতি মাইয়ারে বিবাহ দিয়াই খালি খান্ত হন নাই। জামাই দশরথের রাজ্য পরিচালনার লাইগা লগে লগে সাপ্লাই দিছিলেন পুরোহিত বশিষ্ঠ আর সেনাপতিও। এতে দশরথ বেশ আরামেই নিজের ছোট রাজ্যখান পরিচালনা করতে পারছেন অতদিন…

যেহেতু ভরতই রাজা হইব দশরথের পরে সেই কারণে প্রশিক্ষণের লাইগা ভরত বাপের ছোট রাজ্যে থাকার চাইতে নানার বড়ো রাজ্যেই থাকত বেশি। আর রাম দেশে…

কিন্তু সব হিসাব বদলাইয়া দিছে অযোধ্যায় বিশ্বামিত্রের আগমণ। দশরথরে সাহসী কইরা তুলছে কেকয় রাজের কাছে দেওয়া কথার অন্যথা করার। দশরথ আইজ সেই সিদ্ধান্ত বদলাইয়া একটা দাও মারতে চান…

হইলে তো হইতেও পারে রামের কান্ধে ভর কইরা কেকয় রাজা আর বশিষ্ঠগো নাগপাশ থাইকা বাইর কইরা আনা যাবে নিজের রাজ্যটারে…

রামেরে রাজ্যের মানুষও পছন্দ করে। অবস্থা যদি বেশি বেসামাল হয় তবে নিজে রিটায়ার গিয়া রামরে সরাসরি রাজা বানাইয়া দিলে বশিষ্ঠও পদ হারাইবেন; আর সেইখানে রামের পুরোহিত হইয়া যদি বিশ্বামিত্র আইসা উপস্থিত হন; তবে কেকয় রাজার সব প্রভাবই একলগে ভাইসা যাবে বাতাসে…

জন্ম থাইকাই রাম জাইনা বড়ো হইছে যে বাপের পরে রাজা হইব ছোটভাই ভরত। কথা বলার জায়গা নাই দেইখা রাম কোনোদিন সেই বিষয়ে একটাও কথা কয় নাই। আর একইভাবে এখন যখন সুযোগটা উপস্থিত; তখন আবারো একটা কথা না কইয়াই যুবরাজ হইবার প্রস্তুতি নিতে থাকে রাম…

সিদ্ধান্ত নিয়া এক রাত্তির পার হইতেই ডর আইসা যোগ হয় দশরথের ভিতর। তিনি স্বপ্নে বহুত হাবিজাবি দেখছেন। ঘুম থাইকা উইঠা তিনি সরাসরি গিয়া হাজির হন রামের ঘরে- পুত কোন সময় কী হয় কে জানে। আমারই মতিগতি কখন বদলাইয়া যায় আমিও জানি না। খামাখা বড়ো আয়োজনের লাইগা সময় নষ্ট করার মানে নাই। আমি কাইল ভোরেই তোর অভিষেক কইরা ফেলতে চাই...

অভিষেকের আয়োজন সংক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু সংক্ষিপ্ত হইলেও অযোধ্যার যুবরাজ পদে অভিষেক বইলা কথা। তাও মাত্র একদিন পর। বাড়ি জুইড়া হইহল্লা হুড়াহুড়ি। সকলের সেই অস্বাভাবিক দৌড়াদৌড়ি চোখে লাগে কৈকেয়ীর দাসী মন্থরার। সে গিয়া মাইনসেরে জিগায়া জানতে পারে যুবরাজ হিসাবে রামের অভিষেক হইব আগামী কাল ভোরে; পুষ্যা নক্ষত্রের লগনে...

মন্থরা দৌড়ায় কৈকেয়ীর কাছে- রাজায় যে লুকায়া রামরে রাজ্য দিতাছেন সেই খবর রাখো?

কৈকেয়ী আকাশ থাইকা পড়ে। মন্থরা কয়- ধইরা নিতে পারো তোমার পোলায় চিরকালের লাইগাই নানাবাড়ি গেছে। রাম যুবরাজ হইলে সেইখানে বইসাই ভরত নির্বাসনদণ্ড শুনব রাজার কাছ থিকা যাতে আর কোনোদিনও সে ফিরতে না পারে অযোধ্যায়...

কৈকেয়ী কিছু কয় না। রামের বীরত্ব দেইখা তবে সিদ্ধান্ত পাল্টাইয়া ফালাইছেন দশরথ? মন্থরার হিসাবই ঠিক। রাম এখন যুবরাজ আর পরে রাজা হইলে ভরতের আর অযোধ্যায় ফিরা হইব না...

কিছু একটা করা লাগবে। কিন্তু কী করা যায়?
মন্থরা কয়- একটা উপায় কিন্তু এখনো তোমার কব্জায় আছে কৈকেয়ী রানি...

রানি থ মাইরা মন্থরার দিকে তাকান- কী?
-আমার ধারণা শেষ মুহূর্তে রাজা তোমারে সংবাদটা জানাইতে আসবেন। আর যদি রাইতের মইদ্যে না আসেন তবে তুমি তারে তোমার ঘরে আনানোর ব্যবস্থা করবা। ঠিকাছে?
সেইটা না হয় হইল। কিন্তু তিনি আসলে কী করব আমি?
মন্থরা কয়- রাজার কাছে দুইটা জিনিস চাইবা তুমি। এক; রামের বদলা ভরতের অভিষেক আর আর দুই; রামের চৌদ্দ বচ্ছর বনবাস…

কৈকেয়ী প্রস্তুতি নেয়; পরিকল্পনা মতো মন্থরা যায় আয়োজনের কামে। এইদিকে কৈকেয়ীরে এক্কেবারে না জানাইলে কথা থাইকা যাবে। আর এখন এই রাত্তিরে জানাইলে কোনো ঘিরিঙ্গির ভয় নাই। তাই রাত্তিরে আইসা রাজা দশরথ উপস্থিত হন কৈকেয়ীর মহলে। কিন্তু সব কেমন আউলাঝাড়া। রাজা দারোয়ানরে জিগান- রানি কই?
দারোয়ান কয়- রানিমা ঘরেই আছেন…

রানিরে খুঁজতে খুঁজতে এই ঘর সেই ঘর পার হইয়া এক্কেবারে ভিত্রের ঘরে আইসা রাজা দেখেন রানি বিছানাপত্র রাইখা মুখ গোমড়া কইরা মাটিতে শোওয়া। একটা সুসংবাদ দিতে আসছেন রাজা। রানির রাগ না ভাঙাইয়া তো আর সেই সংবাদটা দেওয়া সম্ভব না। তাই রাজা রানিরে তেলান- কী কারণে রাগ হইছে কও। কেডা তোমার লগে বেয়াদবি করছে কও আমারে। আমি তাগো কল্লা কাইট্টা ফালামু। তোমার কি শরীর খারাপ? আমি অত টেকা বেতন দিয়া একপাল কবিরাজ পুষি। শরীর খারাপ হইয়া তুমি মাটিতে পইড়া থাকবা এইটা কি হয়? আমি এক্ষুনি ডাকতাছি তাগোরে...

রাজা তেলান কিন্তু কৈকেয়ী কিচ্ছু কন না। রানিরে কথা কওয়াইতে আরো তেলাইতে থাকেন রাজা- তুমি কও কার মাথা কাটতে হইব। কোনো দোষ না থাকলেও তুমি কইলে আমি যে কারো মাথা নামাইয়া দিতে পারি। যদি কও যে কোনো বন্দীরে ছাইড়া দিতে হইব; আমি এক্ষুনি তা দিতাছি। কাউরে যদি দান খয়রাত করতে চাও; তাও কও। আমি রাজকোষ খুইলা দিতাছি। তবু কথা কও…

কৈকেয়ী কন- আমার বাপেরে দেওয়া কথা ফিরাইয়া নিয়া আমারে এইসব দিয়া খুশি করা যাবে বইলা মনে হয় তোমার?

চমকিয়া উঠেন দশরথ। কথাটার অর্থ বুঝতে বুঝতেও না বুঝার ভান কইরা তিনি জিগান- কী? কী কও তুমি?
রাজার চোখে চোখে চোখ রাখেন কৈকেয়ী- শুনলাম লুকায়া রামেরে যুবরাজ করার চেষ্টা চলতেছে?
রাজা থতমতো খান- না মানে। লুকায়া হবে কেন?
- আমারে জানানো হয় নাই ক্যান?
- হইবা না ক্যান? মানে তোমারে জানাইতেই তো আসলাম…
- কিন্তু তারে যুবরাজ বানানো হইতেছে ক্যান?

দশরথ ঘামতে থাকেন। না মানে; দেখো সে আমার বড়ো পোলা। এইটাইতো স্বাভাবিক…
- কিন্তু তুমি তো কথা দিছিলা তোমার পরে রাজা হবে ভরত…

রাজা ঘামতে থাকেন- কথা ঠিকাছে। কিন্তু সেইটাতো পোলাপানের জন্মের আগের কথা। আর দেখো ভরতরে অযোধ্যার কেউ চিনে না; সেও চিনে না অযোধ্যার কিছু। সে সব সময় নানাবাড়ি পইড়া থাকে। আর এই দিকে রামেরে সবাই পছন্দ করে। সে যুবরাজ হইলে…

কৈকেয়ি দশরথের দিকে তাকান- যেইভাবে কথা আছিল সেইভাবেই হবে। ভরতই রাজা হবে তোমার পরে। যুবরাজ হিসাবে অভিষেক ভরতেরই হবে…

রাজা আমতা আমতা করেন- অভিষেক তো কাইল। আর ভরত তো নানাবাড়ি…
- ফালতু কথার সময় নাই। রাম যুবরাজ হইব না ব্যাস। আর এই রাজ্যেও থাকব না সে…
রাজা এইবার আকাশ থেকে পড়েন- রাম রাজ্যে থাকব না মানে?
- থাকব না মানে থাকব না। রাম দণ্ডক বনে বনবাসে যাবে চৌদ্দ বছরের লাইগা; যাতে ভরতের রাজ্যে আর কোনো কাঁটা না থাকে...
দশরথ হুংকার দিয়া উঠেন- ফাইজলামি পাইছ? তুমি যা বলবা তাই করতে হবে? এইটা আমার রাজ্য; আমি কারে দিমু না দিমু সেইটা আমার সিদ্ধান্ত…

কৈকেয়ীর গলা ঠাণ্ডা- যতক্ষণ পর্যন্ত না রাম বনবাসে গেছে; ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি এই ঘর থাইকা বাইরে যাইতে পারবা না। চেষ্টা করলে জানও যাইতে পারে…

রাজা বেকুবের মতো হা কইরা রানির দিকে তাকাইয়া থাকেন। তারপর হিসাব করেন। এই ঘরে ঢুকতেই সব কিছু কেমন আউলাঝাড়া মনে হইছিল। এখন পরিষ্কার হয়; কেকয়রাজ অশ্বপতির মাইয়ার হাতে তিনি বন্দী হইয়া আছেন…
২০১৭.১০.০৭ রোববার

নোট:
১। অযোধ্যা রাজ্যের সীমা আছিল দৈর্ঘ্যে বারো আর প্রস্থে তিন যোজন। যোজনের সঠিক হিসাব নাই। পুঁথিপুস্তক ঘাঁইটা এক যোজন সমান সাড়ে ছয় কিলোমিটার থাইকা তেরো কিলোমিটার পর্যন্ত হিসাব পাওয়া যায়। আমি এর গড় বাইছা নিছি। এতে অযোধ্যার সীমা তিন সাড়ে তিন হাজার বর্গ কিলোমিটারের মতো হয়; যেইটা মোটামুটি দিনাজপুর জেলার সমান…
২। গল্প বদলাইছে; সচলে ছাপা হওয়া চাইর পর্বের মাঝে তৃতীয় পর্ব থাইকা ব্যাপক। কিন্তু আগের খসড়াগুলায় বেশ কিছু ভালো কমেন্ট থাকায় সেইগুলা ডিলিট না মাইরা রাইখা দিলাম চলতি পাঠ হিসাবে। পয়লা দুই পর্বেও বদলাইছে কিন্তু সেইগুলা আপাতত নতুন কইরা শুরু না করলেও চলবে মনে হয়..

………………
সহজিয়া রামায়ণ ৪ (প্রথম খসড়া)
সহজিয়া রামায়ণ ৩ (প্রথম খসড়া)
সহজিয়া রামায়ণ ২
সহজিয়া রামায়ণ ১
.....
রামায়ণের শোলক সন্ধান ৫: রামায়ণ থেকে মহাভারত প্রাচীন আখ্যান
রামায়ণের শোলক সন্ধান ৪: রাম নয় কৃষ্ণই প্রাচীন
রামায়ণের শোলক সন্ধান ৩: বাল্মিকী কি ভিল জাতির মানুষ?
রামায়ণের শোলক সন্ধান ২: সীতার সতীত্ব পরীক্ষা
রামায়ণের শোলক সন্ধান ১: সীতা কার মেয়ে?


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক দিন পর লীলেন। এইবার আর থামাথামি চলবে না।
---মোখলেস হোসেন

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ আশা করা যায় চলবে এখন; একটানা হাজারখানেক তামিল সিনেমা দেখার পর আবার মনোযোগ ফিরাইয়া আনতে পারছি

সোহেল ইমাম এর ছবি

বাহ!! তুমুল সাসপেন্সের জায়গায় থামালেন লীলেনভাই। কৈকেয়ির হাতে বন্দি রাজা। পরের পর্ব আরো দ্রুত আসুক।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আইসা পড়বে; কৈকেয়ীর বাপের লগে দশরথের চুক্তিমুক্তি খুঁজতে গিয়া মাঝখানে বহুত সময় গেছে গা

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আচ্ছা, এই মন্থরাই কি "একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে?" এর কারণ?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ইনি তিনিই; কেউ কেউ কন ইনি কৈকেয়ীর দাসী আর দুধমা হিসাবে পরিচিত হইলেও মূলত ইনিই কৈকেয়ীর গর্ভধারিণী মা; ওই দাবির পক্ষে জোরালো পুস্তক পাইনাই বইলা সেইদিকে আর আগাইনাই আমি

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক । চলুক।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আশায় থাকি আমিও

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলায়তনে প্রবেশ করামাত্র লিলেন ভাইয়ের গপের স্বাদ! ইনশকান লেখন যায়! আম্ম হুঙ্কা থাইক্কা এ লাখান লেখমু। অসম্ভব চমাতকার হয়েছে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

লেখেন; তাইলে আমারো সুবিধা হইব নিজের লেখা যাচাই করার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।