সালিশ মানি, কিন্তু তুই ব্যাটা পাগল !

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২৬/০৫/২০১২ - ৩:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূলঃ মার্ক টোয়েন

ইষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদঃ মন মাঝি



আসুন, তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নেই আমরা সবাই আংশিক ভাবে পাগল। তাতে কি হবে? তাহলে আমরা একে অপরের কাছে অনেক বেশি বোধগম্য হব, অনেক ধাঁধারই জট খুলে যাবে। অনেক ল্যাচ্চড়মার্কা জটিল আর দুর্বোধ্য বিষয়ই তখন জলবৎ তরলং হয়ে যাবে।

আমরা যারা পাগলা গারদে থাকি না - আর সেখানে থাকার জন্য এখনো বাহ্যিকভাবে অন্তত পরিপূর্ণ যোগ্য হয়ে উঠিনি, তারা, অন্তত দুয়েকটা ক্ষেত্রে যে সেখানে যাওয়ার যোগ্য আছি সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আমার মনে হয় এটুকু আমাদের স্বীকার করে নেয়াই উচিৎ। তবে, অন্যথায় আমরা যথেষ্টই সুস্থ-মস্তিষ্ক। আমার মনে হয় আমরা সবাই যখন একটা জিনিষ একই ভাবে দেখি, তখন এটা প্রমান করে যে, ঐ একটা জিনিষের ক্ষেত্রে অন্তত, আমরা মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। শুধু একটা জিনিষই নয়, আসলে আমরা সবাই বেশ অনেকগুলি জিনিষই একই ভাবে দেখি, যেসব জিনিষ আমরা সবাই মেনে নেই, আর তা নিয়ে তর্ক করি না। যেমন ধরুন, আমরা যারা পাগলা গারদের বাইরে আছি তারা সবাই একমত যে পানির উপরিভাগের সমতল থাকার একটা প্রবণতা আছে, সূর্য আলো আর তাপ ছড়ায়, আগুন পোড়ায়, কুয়াশা স্যাঁতস্যাতে, ছয় দিয়ে ছয় গুণ করলে ছয়ত্রিশ হয়, দশ থেকে দুই বাদ দিলে আট থাকে, আট যোগ সাত হচ্ছে পনের, ইত্যাদি। এজাতীয় বিষয়গুলি সম্ভবত একমাত্র বিষয় যে ব্যাপারে আমরা একমত। কিন্তু যদিও এধরণের বিষয় পরিমানে বা বৈচিত্র্যে খুবই কম, এদের মূল্য কিন্তু অপরিসীম, কারন এরা মানসিক সুস্থতার একটা অনস্বীকার্য মান নির্ধারণ করে দেয়। যে এই বিষয়গুলিতে একমত হয় তাকে আমরা যথেষ্ট পরিমানে মানসিক ভাবে সুস্থ বলে গণ্য করি, কাজ চালানোর মত ওক্কে মনে করি। কিন্তু এর একটাও যে অস্বীকার করে, তাকে কিন্তু আমরা পুরাই পাগল ভাবি, পাগলা গারদের উপযুক্ত মনে করি।

বেশ, যে লোক এ জিনিষগুলির কোনটাতেই দ্বিমত প্রকাশ করে না তাকে আমরা মুক্ত ভাবে বিচরণ করার অধিকার দেই। কিন্তু ঐটুকুই দেই, তার একটুও বেশি না। কারন আমরা জানি, নিছক মতামত সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে ঐ একই লোক একটা বদ্ধ উম্মাদ -ঠিক যতটা আমরাও উম্মাদ, ঠিক যতটা শেক্সপিয়ারও উম্মাদ ছিলেন। আমরা খুব ভাল করেই জানি তার পাগলামিটা আসলে ঠিক কোথায়। এটা ঠিক সেখানেই, যেখানে তার মতামতটা আমাদের থেকে ভিন্ন।

এটা খুবই সহজ একটা সূত্র। সহজেই মনে রাখা যায়। আমি, একজন চিন্তাশীল ও সাধারণ প্রেসবিটারিয়ান যখন কোরান পড়ি, তখন সন্দেহাতীত ভাবেই হৃদয়ঙ্গম করি যে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানই পাগল। সব বিষয়ে না হলেও ধর্মীয় বিষয়ে তো বটেই। একইভাবে, একজন চিন্তাশীল ও সাধারণ মুসলমান যখন ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির প্রশ্নোত্তরচর্চা দেখে, তখন তার কাছে নিঃসন্দেহেই আমি একজন ধর্মবোধের ক্ষেত্রে পাগল বলে প্রতিভাত হই। আমি তার কাছে প্রমান করতে পারব না যে সে একটা পাগল, যেহেতু একটা উম্মাদের কাছে আপনি কোনদিনও কিছু প্রমান করতে পারবেন না - কারন তার আত্নসুস্থতাবোধ তার উম্মাদনারই একটা অংশ এবং একই সাথে তার প্রমানও বটে। আবার সেও আমার কাছে প্রমান করতে পারবে না যে আমি একটা বদ্ধ পাগল, কারন আমার মানসেও সেই একই ত্রুটি রয়ে গেছে যেটাতে সেও আক্রান্ত। সব ডেমোক্রেটরাই উম্মাদ, কিন্তু তাদের একজনও এই মহাসত্যটা জানে না, জানে শুধু রিপাবলিকান আর মাগওয়াম্পরা ['মাগওয়াম্প' রিপাবিকানদের একটা উপদল যারা ১৮৮৪-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিল ]। সব রিপাবলিকানরাই উম্মাদ, কিন্তু খালি ডেমোক্রেট আর মাগওয়াম্পরাই সেটা টের পায়। এই সূত্রটা তাই একদম নির্ভুলঃ মতামত সংক্রান্ত সকল ব্যাপারে আমাদের প্রতিপক্ষরা বদ্ধ পাগল। আমি যখন আমার চারিদিকে তাকাই, তখন সবখানে এত এত পাগল দেখি যে সত্যিই আমি বিব্রত বোধ করি। এদের অল্প কয়েকটার উদাহরণ এখানে দেইঃ

নাস্তিক, এগনস্টিক, থিওসফিস্ট, বিধর্মী, সুইডেনবোর্গিয়ান, শেইকার, বাপ্টিস্ট, মিলেরাইট, মেথডিস্ট, মর্মন, ক্রিশ্চিয়ান-সাইন্টিস্ট, লরেন্স অলিফান্ট হ্যারিসাইট, ক্যাথলিক, এবং আরও ১১৫টি খৃষ্টীয় সম্প্রদায় - প্রেসবিটারিয়ান বাদে, তিব্বতি বৌদ্ধ, রাজতন্ত্রবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, ৭২টি মুসলমান সম্প্রদায়, ডেমোক্রেট, রিপাবলিকান (তবে মাগওয়াম্পরা না), বৌদ্ধ, ব্লাভাট্‌স্কিবাদী-বৌদ্ধ, মাইন্ড-কিউরিস্ট, ফেইথ-কিউরিস্ট, জাতীয়তাবাদী, মনস্তাত্ত্বিক, কনফুসিয়ান, স্পিরিচুয়ালিস্ট, এ্যালোপ্যাথ, ২০০০ ইস্ট-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়, হোমিওপ্যাথ, ইলেক্ট্রোপ্যাথ, আজব লোক, গু...

নাঃ এই তালিকা শেষ হওয়ার নয় - দুনিয়াজুড়ে লক্ষ লক্ষ জাতের পাগল আছে! এরা সবাই পাগল, প্রত্যেকেই নিজের মত করে আর নিজ নিজ ঝোঁক বা মতামতের ব্যাপারে পাগল, কিন্তু অন্য ব্যাপারে বেশ সুস্থ আর যুক্তিশীল। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে মনে হয় আমাদের একে অন্যের পাগলামির প্রতি আরও ক্ষমাশীল হওয়া প্রয়োজন। আমি মানছি যে 'ক্রিশ্চিয়ান সাইন্টিস্ট' [একটি বিশেষ খৃষ্টধর্মীয় মতবাদ বা তার অনুসারী] তাঁর বিশেষ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একজন উম্মাদ, কারন আমি যা বিশ্বাস করি তিনি তা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি তাঁকে মিত্র ও সহযাত্রী হিসেবেই স্বীকার করি, কারন আমিও তাঁরই মত উম্মাদ যেমনটা তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে আমার কাছে, আর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ততটাই প্রামান্য যতটা কিনা আমার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রামান্য, আর এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির দামও আসলে সমান। অর্থাৎ কিনা - কানাকড়িমাত্র ! বিরাট কোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক প্রশ্নে, পৃথিবীর সবচেয়ে মোটা মাথার লোকটার মতামতের দাম আর পৃথিবীর সবচেয়ে চিকনা মাথাওয়ালার মতামতের দামের মধ্যে আসলে কোনই পার্থক্য নেই - দুটোরই দাম ফুটা পয়সা মাত্র। আমরা কিভাবে এটা বুঝলাম? সোজা। একটা মাথামোটার ইতিবাচক মতামত তারই মাথামোটা প্রতিবেশীর নেতিবাচক মতামতের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, উপসংহার - সিদ্ধান্তহীণতা। আবার, একজন জ্ঞানসাগর গ্ল্যাডস্টোনের ইতিবাচক মতামত আরেক জ্ঞানসাগর নিউম্যানের নেতিবাচক মতামতের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, উপসংহার - সিদ্ধান্তহীণতা। যেসব মতামত কিছুই প্রমান করে না, বলাই বাহুল্য সেসব নিতান্তই মূল্যহীণ, এমনকি একটা লাশও সেটুকু জানে। তো এই অবস্থায় আমরা উপরে বলা তিক্ত প্রস্তাবনাটার সারসত্যটা স্বীকার করতে বাধ্য হই যে - রাজনীতি আর ধর্মসংক্রান্ত যেকোন বিতর্কিত ব্যাপারে একজন লোকের মতামতের মূল্য তার সমকক্ষদের মতামতের মূল্যর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর এর থেকেই বোঝা যায় যে, কারও মতামতেরই আসলে কোন দাম নাই। এটা একটা তব্দা লাগানোর মত চিন্তা বটে, কিন্তু একে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেইঃ এইসব মহান বিষয়ে সব মতামতই আসলে ভুয়া।

এটা নেহাতই একটা সহজ সরল সত্য, আট যোগ সাত সমান পনেরর মতই পরিষ্কার আর নিশ্চিত। আর এই সমীকরনের মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি যে, কথিত প্রসঙ্গগুলিতে, আমরা সবাই পাগল। আমরা যদি সুস্থমস্তিষ্কই হতাম, তাহলে সমস্ত রাজনৈতিক আর ধর্মীয় মতবাদেই আমরা একমত হতাম। কোন বিতর্কই থাকত না আমাদের মধ্যেঃ আট যোগ সাতের মতই একটা ব্যাপার হত তখন - ঠিক যেমনটা স্বর্গে ঘটে থাকে, যেখানে সবাই সুস্থমস্তিষ্ক আর কেউই পাগল না। ওখানে একটাই ধর্ম, একটাই বিশ্বাস, সবার মধ্যে নিখুঁত মতৈক্য আর সামঞ্জস্য বিরাজমান - কোথাও এতটুকু ছন্দপতন নেই।

যাহোক, উপরের সব ভণিতার আড়ালে থেকে আশা করি আমি এবার কাউকে আঘাত না দিয়েই আবারও বলতে পারব যে, 'ক্রিশ্চিয়ান সাইন্টিস্ট' একজন উম্মাদ। আমি তার প্রতি কোন অসৌজন্য প্রকাশ করতে চাই না, আর আমি এমনও অভিযোগ করছি না - এমনকি কল্পনাও করছি না - যে তিনি বাকি মানবজাতি থেকে কোনভাবে বেশি উম্মাদ। আমার মনে হয় তিনি আমাদের কারো কারো চেয়ে একটু বেশি বর্ণিল ভাবে পাগল - এই যা। একই সাথে আমি এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে, অন্তত একটা গুরুত্বপূর্ন আর চমকপ্রদ ক্ষেত্রে তিনি জাতির অধিকাংশের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ।

কিন্তু, তিনি কেন পাগল? আমি আপনাদের আগেই বলেছিঃ এর কারন তাঁর মতামতগুলি আমাদের নয়। আমি আর কোন কারন জানি না, আর কোন কারনের ধারও ধারি না। সহিংস না হয়ে উঠা পর্যন্ত, পাগলামি চেনার এটাই আমাদের একমাত্র উপায়।


মূলঃ মার্ক টোয়েনের "ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স" গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৫ম অধ্যায়
ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদঃ মন মাঝি



মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এখন পৃথিবীতে ৭০০কোটি পাগল, ভাবতে ভালই লাগছে আমিও এর এক গর্বিত সদস্য । দেঁতো হাসি

*সগ্যে এক ধম্য- এক বিসোয়াস্, নরকের কী অবস্থা জানিতে আশ্ ।

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
কড়িকাঠুরে

মন মাঝি এর ছবি

নরকে বহু ধম্য, বহু বিসোয়াস্ - পাগলে ভর্তি একটা পৃথিবীকুন্ড!

****************************************

রিয়েল ডেমোন এর ছবি

চারপাশে অসংখ ট্রেন, সাবধান খাইছে

জ.ই মানিক এর ছবি

হ; সত্য চিরন্তন, বাক্যে বাক্যে।
পছন্দ লাগসে।
স্যালুট, দুইজনরেই।

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

তারেক অণু এর ছবি

দেঁতো হাসি আসুন, তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নেই আমরা সবাই আংশিক ভাবে পাগল। তাতে কি হবে? তাহলে আমরা একে অপরের কাছে অনেক বেশি বোধগম্য হব, অনেক ধাঁধারই জট খুলে যাবে। অনেক ল্যাচ্চড়মার্কা জটিল আর দুর্বোধ্য বিষয়ই তখন জলবৎ তরলং হয়ে যাবে।
[b] গুল্লি [/b]

মন মাঝি এর ছবি

দেঁতো হাসি

****************************************

ম্যাক্স ইথার এর ছবি

পড়তে পড়তে মাথা আউলাইয়া গেল । এ আমি কি পড়লাম ।।।

মন মাঝি এর ছবি

অ্যাঁ

****************************************

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অ্যাঁ মানুষ মাত্রেই পাগল!!!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

হ, তয় আমরা নিজেরা বাদে দেঁতো হাসি

****************************************

তানিম এহসান এর ছবি

ননমনফিকশন! পছন্দ হল হাসি

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

এটা লেখার পর জীবনের একটা বিরাট অংশ -- পুরো ১১-টা বছর -- এরই মধ্যে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেছে বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না!!! মনে হচ্ছে এই গতকালই যেন লিখেছিলাম, কিন্তু না...
"প্রৌঢ় ভাবনা" এবং এমন আরও কোনো কোনো সচলের মত আমিও একদিন থাকব না এখন মনে হচ্ছে, কিন্তু আমাদের এইসব ভালোবাসার আঁকিবুঁকির চিহ্ন বুকে ধারণ করে সচল তখনও হয়তো থাকবে পৃথিবীর সূর্যালোকিত উম্মুক্ত প্রান্তরে.... থাকবে কি? আশা করি থাকবে.....

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কী থাকবে আর কী থাকবেনা সেসব মিছেই ভেবে কী হবে! এরচেয়ে আসুন প্রবলভাবে বর্তমানে বাঁচি। পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-শব্দ সব কিছু পুরো মাত্রায় উপভোগ করি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।