দু’টি হত্যাকান্ড, ‘উত্তেজিত সৈনিক’ তত্ত্ব এবং অন্যান্য

নৈষাদ এর ছবি
লিখেছেন নৈষাদ (তারিখ: শনি, ০৪/১১/২০১৭ - ৬:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুক্তিযুদ্ধাকালীণ দুই নাম্বার সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং 'কে-ফোর্স'-এর সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম পরিকল্পনাকারি মেজর এটিএম হায়দার বীরউত্তম এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী কর্ণেল খোন্দকার নাজমুল হুদা বীরউত্তম – এই তিন মুক্তিযুদ্ধাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর। আরেক মুক্তিযুদ্ধা, আট নাম্বার সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীরউত্তমকে হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালের ২রা জুন।

সরকারি এবং পরবর্তীতে বহল প্রাচারিত ভাষ্যমতে দুটো ঘটনাই ঘটায় ‘উত্তেজিত সৈনিকেরা’। দুটো হত্যাকান্ডের ঘটনায় কিছু মিল আছে।

সামরিক কর্মকর্তা এবং বেসামরিক লেখকের লেখা বিভিন্ন বই থেকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের হত্যাকান্ডের একটা ছবি দাঁড় করানো যায়। ১৯৭৫ সালে নভেম্বরের ছয় তারিখ রাতে যখন তথাকথিত সিপাহী-জনতার বিপ্লব শুরু হয় মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ মেজর হায়দার এবং কর্নেল হুদা সহ বঙ্গভবনে ছিলেন। রাত বারোটার পর তাঁরা ব্যক্তিগত গাড়িতে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন এবং কলাবাগানে এক আত্মীয়ের বাসায় (অথবা রক্ষীবাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানের বাসায়) আসেন (মধ্যেখানে ধানমন্ডি ২৭ নাম্বারে গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা ঘটনা আছে)। সেখানে তাঁরা সামরিক পোশাক ছেড়ে সাধারন পোশাক পরেন। তাঁরা তখন আত্মগোপন করতে পারতেন, কিংবা নিশ্চিত আশ্রয়ে যেতে পারতেন। (যেমনটি করেছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল কিংবা কর্নেল মালেক)।

বোধগম্য কারণেই মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ শেরে বাংলা নগরে অবস্থানরত ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ‘কে-ফোর্সের’ অধীনে তারই কমান্ডে যুদ্ধ করেছিল। তিনি হুদা ও হায়দারসহ সেখানেই গিয়েছিলেন।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, তার নির্দেশেই রংপুর থেকে ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আগের দিন ঢাকায় আসে। খালেদ মোশাররফের সহযোগী এবং ৩রা নভেম্বর অভ্যূথানের আরেক রূপকার কর্নেল শাফায়াত জামিলের ভাষ্যে জানা যায়, কোন এক কারণে (এম, এ হামিদ বলছেন, ঢাকায় তার সমর্থন বাড়াতে) খালেদ মোশাররফ নভেম্বরের ৫ তারিখে রংপুর ব্রিগেড থেকে ২ ব্যাটালিয়ন এবং কুমিল্লা ব্রিগেড থেকে ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন। রংপুর ব্রিগেড থেকে যদিও সৈন্য এসেছিল (১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট), কোন এক অজ্ঞাত কারণে কর্নেল আমজাদ খান চৌধুরি কুমিল্লা থেকে সৈন্য পাঠানো থেকে বিরত থাকেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এই আমজাদ খান চৌধুরির অধিনের কুমিল্লা ব্রিগেড (কুমিল্লা থেকে আসা ১ম আর্টিলারী রেজিমেন্টের সৈনিকরা) বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সময় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।

শেরে বাংলা নগরে অবস্থানরত ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ (তিনিও বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৮১ সালের প্রহসনের বিচারে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়)। কর্নেল নওয়াজিশকে দেয়া হয় খালেদের আগমনের সংবাদ এবং তিনি তৎক্ষণাৎ টেলিফোনে সদ্যমুক্ত জেনালের জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মোশাররফের উপস্থিতির কথা জানান। তখন ভোর প্রায় চারটা।

সকাল দশটার দিকে ‘সেনা-কর্মকর্তা’ মেজর জলিল এবং মেজর আসাদের নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা করা হয়। (এই জলিল জাসদের মেজর জলিল না।) ৩রা নভেম্বর অভ্যূত্থানে খালেদ মোশাররফের সহযোগী মেজর নাসির এবং অন্যান্যদের মতানুসারে, কর্নেল তাহের এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলীর আদেশে এই তিনজনকে হত্যা করা হয়। (জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতির লেখক মহিউদ্দিন আহমদও এই মতের পক্ষে।)

অন্যদিকে ১৯৮১ সালের ১ জুন যখন ‘বিদ্রোহের’ অভিযোগে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ফটিকছড়ি থেকে ‘আটক’ করা হয়, তখন তিনি সশস্ত্র ছিলেন, কিন্তু কোন বাধা দেননি। ফটিকছড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক সময় এবং সুযোগ তার ছিল। তবে তাকে আটকের পর যখন পুলিশ-সামরিক বাহিনীর মধ্যে তার দখলদারিত্ব নিয়ে টানা-হিচড়া চলছিল, তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ‘পুলিশ-কাস্টডিতে’ থাকতে। তিনি নিশ্চিত বুঝতে পারছিলেন সামরিক বাহিনীতে তার পরিনিতির কথা।

সরকারি ভাষ্যে যদিও মঞ্জুরকে নিয়ে সেনানিবাসে ঢোকার মুহূর্তে ‘উত্তেজিত সৈনিকের’ হাতে হত্যার কথা বলা হয়, সেনানিবাসে পরিকল্পিত হত্যার একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয় তখনকার চট্টগ্রামের ডিসি জিয়াউদ্দিন চৌধুরির ভাষ্য (তার লেখা বই)। তিনি বেসমরিক প্রসাশনের পক্ষ থেকে পুরো ব্যাপারটায় জড়িত ছিলেন, এবং ঘটনাগুলি খুব কাছ থেকে দেখেছেন।

জেনারেল মঞ্জুরের মৃতদেহের যিনি ডাক্তারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন, সেই ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত কথা বলেছেন জিয়াউদ্দিন চৌধুরি। (তার ইংরেজিতে লেখা বইতে ডাক্তারের নাম উল্লেখ করা হয়নি)। সেই ডাক্তার ঘটনাক্রমে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃতদেহেরও ডাক্তারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন।

সেই ডাক্তারের ভাষ্যমতে ঢাকা থেকে আগত ব্রিগেডিয়ার মর্যাদার একজন কর্মকর্তা (নাম উল্লেখ করা হয়নি) মঞ্জুরের কারাকক্ষে গিয়ে গুলি করে তাকে হত্যা করেছিলেন। সেই কর্মকর্তা শুধু একটা ‘মিশন’ নিয়েই চট্টগ্রামে এসেছিলেন। মেজর জেনারেল মঞ্জুরের শরীরে তার মাথা ভেদ করে চলে যাওয়া একটি মাত্র বুলেটের ক্ষত ছিল। (“ he found Manzoor dead from a single bullet which had pierced his head clean through – not from a volley of bullets”)।

পঁচাত্তর এবং একাশিতে সেনাবহিনীতে ‘প্রকাশ্যে’ প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, যার বলি হয়েছেন কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধারা।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, মোটাদাগে আমি এটাকে দু’ভাগে ভাগ করি। একটা মূল হত্যাকান্ডের জন্য সামরিক পরিকল্পনা, আরেকটা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা। মুল হত্যাকান্ডের সামরিক পরিকল্পনা খুব একটা ভাল ছিল বলা যাবে না। হত্যাকান্ডে ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট - বেঙ্গল ল্যান্সারস আর টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট-এর সৈনিকদের। সর্বমোট ১১০০- ১২০০ সৈন্যের মধ্যে ২০০-৩০০ জন অংশগ্রহন করেছিল বলে বিভিন্ন লেখায় মনে হয়েছে।

ঘাতক-দল পরিকল্পনার সময় থেকে ১/২ ঘন্টা দেড়িতে পৌছায়। ফারুকের নেতৃতে ট্যাঙ্ক এদিক সেদিক চলে গেছল। রশিদের টু ফিল্ড আটিলারি ইউনিট ৬টি ১০৫ মি.মি. হাউইটযার আক্রমণে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে যখন গোলাগুলি চলছিলো তখন একটি হাউইটযার দিয়ে বেশ কয়েক রাউন্ড গোলা বর্ষণও করা হয়, যার কিছু গোলা মোহাম্মদপুর অঞ্চলে যেয়েও ক্ষতিসাধন করে।

কিন্তু হত্যাকান্ড পুর্ববর্তী এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা অত্যন্ত ভালভাবে করা হয়েছিল। আমি এখানেই বেসামরিক এবং বিদেশের সহযোগিতা ছাপ দেখতে পাই। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পঁচাত্তরে দেশি-বিদেশি অনেকে সেনানিবাসে অবাধে যাতায়াত করত, ফারুকের সাথে মিটিং করত, ক্লাবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আতিথ্য গ্রহন করত। কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায়, ব্রিটিশ মিলিটারি এটাশে কর্নেল ব্রাউন (যিনি সিআইএর ফিলিপ চেরির সাথে ফারুকের পরিচয় করিয়ে দেন), মেজর জলিল, আবু তাহের, মাহবুব আলম চাষী, এম আই করিম (ইয়াহিয়ার চিফ এডভাইজার)।

আরেকটা ব্যাপার আমার কাছে মনে হয়, মূল হত্যাকান্ডে হত্যাকারীরা হয়ত জানত কোন বাধার মুখে তারা পরবে না – সবার আশীর্বাদ নিয়েই ‘সাজানো মাঠে’ খেলতে নামছে তারা। পুরো প্রেক্ষাপট অনেকদিন থেকে সাজানো হয় (বিস্তারিত লিখলে বিশাল তালিকা হবে)। আসলে পুলিশের সামান্য প্রতিরোধ ছাড়া কোন প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি। লেঃ কর্নেল এম এ হামিদ তার বইতে লিখেছেন, “শেখ সাহেবের বাসায় অপারেশনের সময় মোট তিন দফায় গোলাগোলি হয়। প্রথমবার গেটে ঢুকবার সময় শেখ কামালের সাথে। দ্বিতীয়বার দোতালায় সিঁড়ির মুখে যখন শেখ সাহেব নিচে নেমে আসছিলেন। তৃতীয়বার দোতালার রুম থেকে যখন শেখ কামাল গুলি বর্ষণ করে।“ তিন পরিবারের লোকজন ছাড়া একজন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর মারা যায় সেদিন। (কর্নেল জামিল ছাড়া)

অথচ বঙ্গবন্ধু যখন ফোন করেছিলেন, তখন ৪,০০০ সৈন্যের ৪৬ ব্রিগেড মুভ করানো যেত। পাহাড়ায় থাকা কুমিল্লা ব্রিগেডের সৈন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত। সেই সময় এয়ার কমোডর আমিনুর ইসলাম ছিলেন ডিজিএফআই চিফ, পাকিস্থান-পন্থী এবং প্রাক্তন পাকিস্থানের এনএসআই প্রধান। ‘সেনাবাহিনীর প্রধান’ মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ তাকে কোন গোয়েন্দা বাহিনীই কোন তৈথ্য দেয়না বলে বঙ্গবন্ধুর কাছে বায়না ধরলে তার অধিনে আর্মি সিকিউরিট ইউনিট (এএসইউ) করার অনুমতি দেন বঙ্গবন্ধু। এএসইউ-এর পরিচালক বানানো হয় মেজর গোলাম হেলাল মোর্শেদকে, যিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরদিন ঘুম থেকে উঠে জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।

তবে যেমনটি বলছিলাম, হত্যাকান্ড পুর্ববর্তী এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা অত্যন্ত ভালভাবে করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীতে গুজব ছড়ানো থেকে শুরু করে, টিভি, রেডিও, প্রিন্ট মিডিয়া কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, বেসামরিক সরকার কিভাবে গঠন করা হবে, কাদেরকে হত্যা করেতে হবে, তথাকথিত নতুন সরকারে কারা থাকবে, ঢাকা শহরকে কিভাবে ‘টেরোরাইজ’ করা হবে, পিপল থেকে ইসলামিক রিপাবলিক - আরও বিস্তারিত সব পরিকল্পনা। কিছুদিন আগে জানলাম ‘সুর্য্য-সন্তানদের’ নিয়ে গান রচনা এবং সূর দেয়ার পরিকল্পনাও আগে থেকে করা হয়েছিল।

সেই তুলনায় ৩রা নভেম্বরের অভ্যূত্থানের বিস্তারিত পরিকল্পনার অভাব অত্যন্ত প্রকট। অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে, তবে আমার মনে হয় ৩রা নভেম্বরের অভ্যূত্থান অনিবার্য ছিল। ১৫ আ’গস্টে সেনাবাহিনীর জন্য যে কলংকময় অধ্যায়ের শুরু, তার একটা আপাত পরিনতিতো অবশ্যম্বাবী ছিলই। এবং সম্ভাব্য একটা অভ্যূত্থানের ব্যাপারে এমনকি ‘ঘাতক-মেজররাও’ অবগত ছিল। যদিও একধরণের বেসামরিক মোড়কে তথাকথিত ১৫-আগস্ট পরবর্তী সরকার চলছিল, কিন্তু সবাই জানত ‘ঘাতক-মেজররাই’ বড় সিদ্ধান্ত নিত।

তবে ৩রা নভেম্বরের শুধু সামরিক অভ্যুত্থানের অংশটুকুর পরিকল্পনা খুবই ভাল ছিল। রক্ত তো নয়ই, এমনকি একটি গুলিও খরচ না করে, শুধুমাত্র মানসিক চাপ সৃষ্টি করে অভ্যুত্থান শেষ করা হয়। কিন্তু মিডিয়া কন্ট্রোল, কিংবা পরিবর্তী করণীয় নিয়ে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। আমার ব্যক্তিগত একটা ধারণা খালেদ মোশাররফ কারও কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোন প্রতিরোধ কিংবা অপোজিশন প্রত্যাশা করেননি।

খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা এত বেশি ‘ফোকাসড’ ছিল বুঝানোর জন্য লঃ কর্নেল এম এ হামিদের বই থেকে কয়েকটা লাইন উদ্ধৃত করি, “... যতদূর জানা গেছে, সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করার কাজ, অর্থাৎ প্রথম পর্বের অপারেশন, ৪৬ ব্রিগেডের কিছু তরুণ অফিসার নিজেদের উদ্যোগেই সম্পন্ন করে। ব্রিগেড মেজর হাফিজউদ্দিন এতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। আসলে ফারুক-রশিদের সফল ‘অভ্যুত্থান’ তরুণ মেজরদের অ্যাডভেঞ্চারাস অভিযানে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জিয়াকে তার বাসভবনে বন্দী করার পরই খালেদ মোশাররফকে অভ্যুত্থানের খবর দেওয়া হয়। তিনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন।...“ তার প্রধান প্রতিপক্ষকে কি করা হবে সেটাও তার পরিকল্পনাতে ছিল না।

(অনেকদিন পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম, কিংবা এখনও পুরোপরি সন্দেহ-মুক্ত নই যে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘বন্দি-করা’ এবং তথাকথিত ‘টেলিফোন-লাইন-কেটে-দিলেও-একটা-এক্সেনসন-রয়ে-গেছে’ আসলে তাকে একধরণের ‘সেফ-কাস্টডিতে’ নিয়ে যাওয়া, যেখানে বসে তিনি ‘কল-কাঠি’ নেড়েছেন।) এখানে গুরুত্বপূর্ণ, পাকিস্থানী ভাবধারায় গড় উঠা সামরিক বাহিনীতে জিয়া জনপ্রিয় ছিলেন এবং তার ‘বন্দিত্ব’ তার প্রতি সহানুভুতি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন মেজর হাফিজউদ্দিনই বর্তমান বিএনপি নেতা। কিন্তু তখনকার ব্রিগেড মেজর হাফিজউদ্দিনের ৩রা নভেম্বর অভ্যূত্থানে ভুমিকার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনই অবকাশ নেই। তিনি একেবারে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন এবং লড়ে গেছেন।

পাঁচ তারিখেই বিল্পবী-সৈনিক সংস্থা এবং মুসলীম লিগ ‘অভ্যুত্থানকারীরা রুশ-ভারতের দালাল’ এই লিফলেট বিতরন শুরু করে। প্রস্তুতি চলতে থাকে জাসদের..., তথাকথিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার। এই ব্যাপারে অজ্ঞই থেকে জান খালেদ মোশাররফ অথবা কোন গুরুত্বই দেয় নাই তিনি কিংবা ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা। এটাও ঠিক খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধান হওয়ার বাসনার সুযোগ নিয়ে ধূর্ত খন্দকার মোশতাক খালেদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করেছেন। তারপর ৭ই নভেম্বর দেখি জাসদের অবিমৃশ্যকারিতা। জাসদের উত্থান পতন অস্থির সময়ের রাজনীতির লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী ৭ তারিখের তথাকথিত বিল্পব/অভ্যূত্থানের কোন পরিকল্পনা জাসদের ছিল না, বরং ৯ তারিখ থেকে লাগাতার হরতালের কর্মসুচী তাদের ছিল। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুরোধে কর্নেল তাহের ৭ তারিখের তথাকথিত ‘বিল্পবের’ সূচনা করেন। মহিউদ্দিন এটাও বলেছেন, জিয়া এবং তাহের একে অপরকে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু অন্তিমে জিয়া লাভবান হয়েছেন।

তবে এটাও ঠিক যে ৩রা নভেম্বরের অভ্যূত্থান সফল হলেও দেশ সামরিক শাসন থেকে মুক্তি পেত না, তবে হয়ত আদর্শগত ভাবে যে উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছিল, তার থেকে পরিত্রাণ পেত। এম এ হামিদের লেখা থেকে জানা যায়, ৩রা নভেম্বর অভ্যূত্থানের আগে বঙ্গভবনে সভায় জিয়া-খালেদ দুজনকে ‘সরিয়ে’ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই ‘সরিয়ে’ দেয় – ক্ষমতার বলয় থেকে সরিয়ে দেয়া বলেই মনে হয়।

১৯৮১ সালের চট্টগ্রামের ‘অভ্যূত্থান’ও রহস্যে ঘেরা। পঁচাত্তরের এবং একাশির দুটো ঘটনায়ই মুক্তিযুদ্ধের দুই বীরউত্তমের, এবং সাথে আরো মুক্তিযুদ্ধার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে অন্যরা লাভবান হয়েছে – তার শুধুই দাবার ঘুটির মত ব্যবহৃত হয়েছে – বেড়েছে সামরিক শাসনের বেড়াজাল, ত্বরান্বিত হয়েছে উল্টোপথের যাত্রা।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সংযোজন

কোন কোন বিশ্লেষক খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর সাথে জিয়াউর রহমানের “হত্যার আদেশ দেওয়াকে” সম্পৃক্ত করেন। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জিয়াউর রহমানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের কার্যকলাপ এই দাবীকে শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করায় (মোটিভ এবং বেনিফিসিয়্যারি)। এখন এটা জানার আর কোন উপায় নেই। তবে অন্ততপক্ষে দুইজন সামরিক অফিসার নিশ্চিত করেছেন যে জিয়া কর্নেল নওয়াজিশকে খালেদ মোশাররফের নিরাপত্তার ব্যাপার নিশ্চিতের আদেশ দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে জেলহত্যাকান্ডের সাথে সব বিশ্লেষকরা ‘একা খুনি মোশতাককে’ সম্পৃক্ত করেন। ব্যাপারটা কিচুটা সরলীকরণ করা হয় বলে মনে হয়। দুই নভেম্বর রাতে প্রেসিডেন্সিয়্যাল গার্ড হিসাবে কর্মরত প্রথম বেঙ্গলের সৈনিকরা যেখানে বঙ্গভবনের পাহারা ছেড়ে সরে পরছে, একটা সামরিক অভ্যূত্থান শুরু হতে যাচ্ছে (যেখানে মানুষ মাত্র আড়াই-মাস আগে হত্যাকান্ডে সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা দেখেছে), এই অবস্থায় ঠান্ডা মাথায় মোশতাক জেলে বন্দি নেতাদের হত্যা আগে নিশ্চিত করবেন, এই ধারণা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। (যদিও স্বীকার করি, মোশতাকের সরকার চললে অন্তিমে চার-নেতাকে হত্যা করা হতই)।

ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের তখনকার ডিআইজি প্রিজন খন্দকার আবদুল আওয়ালের রিপোর্টে আমরা দেখি যে জেল-হত্যাকান্ডের আদেশ প্রদান এবং সমন্নয় করেছিল মেজর রশিদ। লে, কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি তার বইতে ২ নভেম্বর রাত্রে কথা লিখেছেন (কোন সূত্রে তিনি এই খবর পেলেন তার কোন ব্যাখ্যা নেই), “গভীর রাত পর্যন্ত বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক, জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খলিল, মেজর রশিদ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপরত ছিলেন। তারা জিয়া এবং খালেদ মোশাররফ এ দুজনের রেষারেষি এবং উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে খুবই বিব্রত বোধ করছিলেন। মোশতাক, ওসমানী, খলিল তারা সবাই চাচ্ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী জিয়াকে সেনাপ্রধান পদ থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু রশিদ একমত হচ্ছিলেন না। জিয়াকে সরিয়ে খালেদ মোশাররফকে চীফ বানানোর পক্ষপাতি ছিল না। যদিও ফারুক চাচ্ছিল খালদে মোশাররফকে চীফ বানানো হোক। কিন্তু বঙ্গভবনে তখন ফারুকের চেয়ে রশিদের মতামতের ওজন বেশি ছিল। এছাড়া দু’জনকে সরিয়ে নতুন কাকে চীফ অভ স্টাফ বানানো যায়, এ নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই ‘উত্তর পাড়া’ থেকে আর একটি অভ্যূত্থানের দমকা হাওয়া বঙ্গভবনের দ্বারপ্রান্ত এসে আঘাত হানলো’।

এদিকে বিদেশে চলে যাওয়ার পরপরও খুনি-মেজরদের সাথে জিয়া-মোশতাক চক্রের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। নভেম্বরের ১৩ তারিখে পাঠানো মার্কিন রাস্ট্রদূত বোস্টারের তারবার্তায় দেখা যায়, (ব্যাংকক থেকে আসা এক আমেরিকান ব্যবসায়ি এবং মেজর রশিদের স্ত্রীর প্রাক্তন কর্মচারির বরাত দিয়ে) ব্যাংককে অবস্থিত খুনি মেজররা সবসময় মোশতাক এবং জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ রাখছে (এবং তারা বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাচ্ছে)। সেই ব্যবসায়ি মোশতাক এবং জিয়াকে লেখা চিঠিও নিয়ে এসেছিল।

আমরা এও জানি, খুনি-মেজর এবং জিয়া সখ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে ‘খুনি-মেজরেরা’ জিয়ার বিরুদ্ধেই একাধিক পাল্টা অভ্যূত্থানের চেষ্টা করে।

লে, কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি তার বইতে ‘কেন ব্যর্থ হল খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থান? – এই বিশ্লেষণে এক জায়গায় লিখেছনে “ফারুক রশিদের দৃঢ় অভিমত, ৩রা নভেম্বরের অভ্যূত্থানের নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ নয়। অর্থাৎ জিয়া – শাফায়াতের গোপন সমঝোতায়ই ৩রা নভেম্বর অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। জিয়াকে তার বাসায় শাফায়াতের ট্রুপসের অত্ত্বাবধানে ‘নিরাপদে’ আটকে রাখা হয়। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা দখলের ঐ দিনগুলিতে বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন মতলবে ভয়ংকর গোপান খেলায় মত্ত ছিল যা উদ্ঘাটন করা বেশ কঠিন। এসব ভবিষৎ অনুসন্ধিৎসুদের গবেষণার ব্যাপার। পরবর্তিতে ঐ অভ্যূত্থানের বিদ্রোহীদের, বিশেষ করে শাফায়াত জামিল ও হাফিজউদ্দিনের প্রতি সদয় ব্যবহার এই ধারণা বদ্ধমুল করে।

শাফায়াত জামিল তার বইতে অভ্যূত্থান শুরুর আগেই জিয়াকে ‘নিরাপত্তামূলক হেফাজতে’ আনার ব্যবস্থাকরার কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, “অন্যদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ জিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে প্রোটেক্টিভ কাস্টডিতে এনে নিস্ক্রিয় করে ফেললো। তাঁর বাসায় টেলিফোন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। খুনি মোশতাক-রশিদ চক্রের কবল থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য’। এখানে উল্লেখকরা উচিত, অভ্যূত্থানে শাফায়াত জামিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল খুনি-মেজরদের কবল থেকে ‘সামরিক বাহিনীকে’ উদ্ধার করা।

৪ নভেম্বরে জেল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে লালবাগ থানায় যে এফআইআর করা হয়েছিল, তা পরবর্তী প্রশাসন গায়েব করে দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর (৭৬৮নং গেজেট বিজ্ঞপ্তি) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যার তদন্তে সাবেক বিচারপতি কে এম সোবহানের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তাদের কোনো নথি বা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেওয়া হয়নি। ৭ নভেম্বর পট পরিবর্তনের পর কমিশনের কার্যকলাপ বাতিল করা হয়।

অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদের একটা লেখায় দেখতে পাই যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতার হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য লন্ডনে স্যার থমাস উইলিয়ামস, কিউসিএমপির নেতৃত্বে একটা তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এই সূত্রে জেফ্রি থমাস ও তার একজন সহযোগীর ঢাকা আসার ভিসার জন্য তদন্ত কমিশনের সচিব ও সলিসিটার অ্যাব্রো রোজ দরখাস্ত করেন। নানা তালবাহানায় ভিসা দেয়া প্রক্রিয়া দেরি হতে থাকে এবং অবশেষে বাংলাদেশ হাইকমিশন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় - জেফ্রি থমাসের ঢাকা গমনের জন্য ভিসা দিতে রাজি নয়।

জেলহত্যাকান্ডের ব্যাপারে এই লুকোছাপা, এবং অন্তিমের বেফিফিসিয়্যারি কে এই বিশ্লেষণ ব্যাপারটাযে এত সরল না, এই ইঙ্গিত দেয়।


মন্তব্য

ফারুকুর এর ছবি

১. তথ্যসুত্র দেওয়া উচিত ছিল। কোন কথা কোন বই হতে পেয়েছেন বুঝা যাচ্ছে না।

২. এককালের জাসদী মহিউদ্দিন সাহেব শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমানের বরাতে ইতিহাসের শুটকি ভর্তা ওরফে মতিহাস পরিবেশন করেন। উনার বইয়ের কথাবাত্রা শুড বী টেকেন উইথ এ বস্তা অফ সল্ট।

৩. ব্রিটিশ এটাচি কর্নেল ব্রাউন আর ফিলিপ চেরির সাথে কর্নেল ফারুকের যোগাযোগ নিয়ে আরও পড়তে চাই। মেহেরবানী করে লিখেন।

নৈষাদ এর ছবি

ধন্যবাদ।

১। খুব বেশি নতুন তথ্য নেই, তাই রেফারেন্স দেই নাই। মূল লেখার পরিকল্পনায় অনেক বেশি তথ্য ছিল, এই মূহূর্তে বিদেশে থাকায় সেগুলি বাদি দিয়ে দিয়েছি (কারণ রেফারেন্স বইগুলি হাতে কাছ ছিল না)। যাই হোক, এই লেখার সব তথ্যের তথ্যসূত্র আছে।

ক) এম এ হামিদের ভাষ্য কিংবা কোটেশন দেয়া হয়েছে – “তিনটি সেনা অভ্যূত্থান ও কিছু না বলা কথা – লেঃ কর্নেল এম এ হামিদ, পিএসসি (অবঃ)” – বই থেকে।

খ) কর্নেল শাফায়াত জামিলের ভাষ্য কিংবা কোটেশন দেয়া হয়েছে – “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর – কর্নেল শাফায়াত জামিল (অবঃ)´- – বই থেকে।

গ) মঞ্জুরে তথ্য নেয় হয়েছে - Assassination of Ziaur Rahman and the aftermath – Ziauddin Chowdhury - – বই থেকে।

ঘ) খালেদ মোশাররফের হত্যায় দুই মেজর এবং নির্দেশ দাতার সহজ তথ্য পাবেন ডিবিসি নিউজ চ্যানেলের টক-শো উপসংহারে (২১/১০/১৬ তারিখ পার্ট ১ এবং ২)। ইউটিউবে পাবেন। বেসামরিক লোকজনের যাতায়াতের তথ্যও সেখানে পাবেন। (বইটা হাতের কাছে না থাকায় বইয়ের রেফারেন্স দিতে পারছিনা।) বলা উচিত কর্নেল শাফায়াত জামিলও তার বইতে পরোক্ষ ভাবে হত্যার সাথে মীর শওকতের যোগসাজগের ব্যাপারে বলেন। (১৪২ পৃষ্ঠা)

২। মহিউদ্দিন সাহেবের ‘মারাত্মক’ কোন তথ্য ব্যবহার করিনি।

৩। লেখার ইচ্ছে আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে বইগুলি হাতের কাছে নেই।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এক প্যাকেটে এতোসব জটিল, আলোচিত, বিতর্কিত বিষয় এনেছেন বস্‌! পাঠক খেই হারিয়ে ফেলতে পারে। এর সবগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মাসের পর মাস লেগে যাবে। এরচেয়ে সময় সুযোগ মতো কিছু কিছু আলোচনা করে যাবো।

প্রথমা ইতিহাস প্রকল্পের মাধ্যমে লেখা তালগোলের ফরমায়েশী ইতিহাসের বাইরের সত্যগুলো আলোচনা হওয়া দরকার। নয়তো মহিউদ্দিন-আবদুল করিম-হাবিবুর রহমানরা এযুগের যদুনাথ-রাখালদাস-নীহাররঞ্জন-রমেশচন্দ্র হিসেবে পূজিত হওয়া শুরু হবে।

১৯৮১ সালের ৩০শে মে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরে ব্যাখ্যাতীত গোলযোগের ঘটনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবুর রহমান বীর উত্তম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান বীর বিক্রমকে হত্যা করা হয়। যেহেতু মৃত ব্যক্তির পক্ষে এসে সাফাই গাওয়া সম্ভব না, তাই অধিকাংশ বর্ণনায় বলা হয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান মদ্যপ অবস্থায় খুব কাছে থেকে সাবমেশিনগানের গুলিতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছিলেন। এইসব বর্ণনা যারা দেন তারা আর বলতে পারেন না ঠিক কার গুলিতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবুর রহমান বীর উত্তম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান বীর বিক্রমকে হত্যা করা হয়েছিল।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

পাণ্ডব’দা, অনেক ধন্যবাদ বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য। বিস্তারিত উত্তর দিব, সময় লাগবে।

আমি জানি অনেক বড় বড় ঘটনা খালি স্পর্শ করে গেছি, আসলে কিছুই বলিনি। হঠাৎ করেই লিখা, প্রথমআলোতে ২ বা ৩ তারিখ একটা লেখা দেখে বিরক্ত হয়েই লেখা, শুধু পাঠকের মনে একটু কৌতুহল সৃষ্টি করা এসব বিষয়ে।

প্রথমআলো প্রজেক্টের (ইদানিং আরও প্রজেক্টের বই এসে গেছে বাজারে) বইই রেফারেন্স হয়ে যাচ্ছে। এই জানুয়ারিতে একগাদা অবঃ’দের বই কিনেছিলাম। প্রজেক্টের প্রচুর বই বাজারে…। যেমন প্রথমা প্রকাশিত - কাছ থেকে দেখা: ১৯৭৩-১৯৭৫ ঃ মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান, ৭১ পরবর্তী রাজনীতিক এবং আওয়ামী লীগের ‘ব্যর্থতার’ কথা লিখছেন... কিন্তু উনি ৭৩ এর ডিসেম্বরে পাকিস্তান ফেরত। ৭৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজের ক্যারিয়ারের কথা লিখছেন, কিন্তু বেমালুম চেপে যাচ্ছেন পচাত্তরের পনেরো আগস্ট পরবর্তী ‘খুনি-মেজরদের’ আন্ডারে ‘চিফ-অভ-স্টাফের’ পদ পাওয়ার কথা। তিনি মৃত্যু বরণ করেছনে ২০০৯ তে, প্রথমার প্রথম প্রকাশ ২০১৬?

কিংবা খন্দকার-মঈদুল-মীর্জার মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর - কথপোকথন নামক ট্র্যাশ।

যাক, বিস্তারিত উত্তর দিব।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

তৎকালীন চিফ অভ ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান জেল হত্যাকাণ্ড ঘটার পর এর খবর পান। কিন্তু তিনি খালেদ-শাফায়েতদের এই তথ্য জানান নাই। খুনী মেজরকূল ব্যাংককে পার হয়ে যাবার পর খালেদ-শাফায়েতরা জেল হত্যাকাণ্ডের কথা যখন জানতে পারেন তখন এই ব্যাপারে জেনারেল খলিলকে প্রশ্ন করলে তিনি নিরুত্তর থাকেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সেনানায়ক ও মুক্তিবাহিনী সংগঠকদের মধ্যে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের মাপের অধিনায়ক বিরল। পৃথিবীতে কতো আলিঝালি জেনারেলদের 'বীরত্বের' ইতিহাস নিয়ে উপন্যাস-চলচ্চিত্র হয়, অথচ খালেদ মোশাররফের মাপের বীরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অমন কিছু হয় না।

খালেদ মোশাররফের মতো মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে খুনীচক্রের বিপক্ষে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে তাঁর আচরণের ব্যাখ্যা মেলে না। যেমন,

১। তিনি খুনী মোশতাককে ২রা নভেম্বর রাতেই গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে না দিয়ে স্বপদে রেখে বহাল তবিয়তে ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত বঙ্গভবনে বসে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবার সুযোগ দিলেন কেন? জেনারেল জিয়াকে তিনি পদ থেকে সরিয়ে দিলেন এবং গৃহবন্দী করলেন। জেনারেল জিয়াকে যদি তিনি আস্থায়ই না নেন্‌ তাহলে গৃহবন্দী করলেন কেন? কেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন না?

২। তিনি কি আমৃত্যু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অন্ধকারে ছিলেন?

৩। তিনি কী করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে ৫ই নভেম্বর নিরাপদে দেশত্যাগ করতে দিয়েছিলেন?

৪। ঢাকা সেনানিবাসে জেনারেল জিয়ার অনুগত বাহিনীর প্রতিবিপ্লব প্রচেষ্টা আর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিপ্লব প্রচেষ্টার ব্যাপারে তিনি কি কিছুই জানতেন না? আচ্ছা, তিনি যদি সেসব না জেনেও থাকেন তারপরেও তাঁর অভ্যুত্থানের পালটা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার হিসেব তো তাঁর থাকার কথা। তাহলে তিনি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেন নি কেন?

৫। সামরিক অভ্যুত্থানের নায়ক সেনানিবাসে না থেকে বঙ্গভবনে ছিলেন কেন? তাঁর দলবল কখন তাঁকে ছেড়ে চলে গেল তিনি সেসব কিছুই টের পাননি? একজন সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান যিনি একটা সামরিক অভ্যুত্থান চালাচ্ছেন তিনি কী করে মাত্র ২/১ জন সঙ্গী নিয়ে বিদ্রোহপীড়িত সেনানিবাসে প্রবেশ করতে যান? যেখানে তিনি বুঝতে পারছিলেন ক্ষমতার লাটাই তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেছে!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঘটনাদৃষ্টে মনে হয় জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করার পরিকল্পনা ৪৬ পদাতিক ডিভিশনের মেজর হাফিজউদ্দিন (বিএনপি নেতা) এবং বেঙ্গল ল্যান্সারের সাবেক অধিনায়ক ও সেসময়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পোস্টেড মেজর নাসিরের। মেজর নাসির ঢাকা এসে মেজর হাফিজের সাথে যোগ দিয়ে কর্নেল শাফায়েত জামিলের অনুমতি নিতে যান। তাঁর অনুমতি পেলে এই দুই মেজর ১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ানের সদর দপ্তরে এসে ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ্‌কে পাঠান জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করতে। পরবর্তী সকল ঘটনাপ্রবাহ থেকে প্রতীয়মান হয় এই গৃহবন্দীত্বের পরিকল্পনা সম্ভবত খোদ জেনারেল জিয়ার। এই জন্য বসবার ঘরের টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও শোবার ঘরের টেলিফোনের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল এবং বেগম খালেদা জিয়া প্রাথমিক পর্যায়ের যোগাযোগগুলো সারতে পেরেছিলেন। তাছাড়া ৬ই নভেম্বর রাতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সিপাহীরা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করতে এসে পৌঁছানোর আগেই জিয়ার অনুগত সেনা সদস্যরা তাকে মুক্ত করে ফেলেছিলেন। ফলে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সিপাহীরা আর পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক জেনারেল জিয়াকে আর সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে যেতে পারেননি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

৭ই নভেম্বরের ঘটনায় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা নাকি কাউকে হত্যা করেননি। টেলিভিশনে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে এমন বক্তব্য দিতে আমি নিজে দেখেছি। যদি তাঁর কথা সত্য হয় তাহলে ৭ই নভেম্বর সকালে সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীকে তাঁর গুলশানের বাসায় এসে হত্যা করতে কারা এসেছিল? এবং তাঁকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রী নাজিয়া খানমকে কারা হত্যা করে গেল? কারা ঢাকা সেনানিবাসে আরও কিছু সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিল? এই ঘটনাগুলোও স্পষ্ট করে জেনারেল জিয়ার অনুগত সেনা সদস্যরা ৬ই নভেম্বর রাতেই পালটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলেছিল।

ঐদিন নিহতদের কয়েকজনের নামঃ
ডেন্টাল সার্জন মেজর করিম
মেজর আজিম
ক্যাপ্টেন খালেক
ক্যাপ্টেন আনোয়ার
লেফটেন্যান্ট সিকান্দার
লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর স্ত্রী নাজিয়া খানম
ডাঃ হামিদা

অর্ডিন্যান্স ডিপোতে নাকি আরও ১০ জন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

খালেদ মোশাররফের যে সকল অসংলগ্ন আচরণ কিংবা পদক্ষেপের কথা পাণ্ডবদা উল্লেখ করেছেন, কোন সন্দেহ নেই সে সকল প্রশ্ন বাঙালি জাতিকে চিরকাল তাড়িয়ে এবং পুড়িয়ে বেড়াবে। খোদ আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘনিষ্ঠ লোকেদের মাঝে এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান ছিল এবং আছে। আওয়ামী লীগের জেল হত্যার শিকার চার নেতার পরিবার বর্গের কাউকে কাউকে এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের অতি উচু স্তরের একাধিক নেতাকে এমনভাবে বলতে শুনেছি যেন ফারুক রশিদ জিয়া খালেদে পার্থক্য কিছু নেই। তা সত্বেও তাঁর ভাই রাশেদ মোশাররফকে গুরুত্বের সঙ্গেই আওয়ামী গ্রহন করা হয় এবং তাঁর কন্যাকেও বেশ সমাদরের সঙ্গেই বিশেষ আসনে এমপি পদে বরন করা হয়।

খালেদের ব্যাপারে উত্থাপিত এসব প্রশ্নের ব্যাপারে এন্থনী মাসকারেনহাস এক ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন- খালেদের পরিকল্পনা ছিল অভ্যত্থান সংঘটনের পর জেল থেকে নেতাদের ছাড়িয়ে নিয়ে এসে তাজউদ্দীনকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন এবং তাজউদ্দীন স্বয়ং রেডিওতে ভাষণটি দিবেন। তার আগে সেনাবাহিনীতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি আগে সেনাপ্রধান হিসেবে অভিষিক্ত হয়ে নিতে চাইলেন। কিন্তু যখন শুনলেন জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, তখন অভাবনীয় এই ঘটনায় তিনি বলতে গেলে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়, চরম সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে সময়ক্ষেপন হতে থাকে।

ওদিকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং কট্টর ডানপন্থী গ্রুপ সৈনিকদের মাঝে প্রধানত অফিসার বিরোধী একটি আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে দেয়, যে নৈরাজ্যের রুপ ছিল অনেকটা বিডিআর বিদ্রোহের মত। সৈনিকদের হয়ত অফিসারদের বিরুদ্ধে এক ধরনের সাধারন ক্ষোভ ছিল, কারো কারো হয়ত বিশেষ কোন অফিসারের প্রতি বিদ্বেষ ছিল, কিন্তু সাধারন সৈনিকদের মাঝে মিশে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং ডানপন্থী গ্রুপের সৈনিকেরা একদিকে যেমন চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তেমনই সুকৌশলে নিজেদের অনুকূলে মেরুকরনের কাজটিও চালিয়ে যেতে থাকে। খালেদের নিজের গ্রুপের সৈনিকেরাও অফিসারবিরোধী সেই নৈরাজ্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে অসহায় খালেদের কার্যত আর কিছুই করার থাকে না।

নৈষাদ এর ছবি

ধন্যবাদ। খালেদ মোশাররফের মত একজন এই লেভেলের একজন সফল সেনানায়কের সাথে এমন পরিকল্পনার মেলানো সত্যিই কঠিন।

তখনকার সেনা-নায়কদের একই কাতারে ফেলে দেখার একটা দৃষ্টিকোণ/প্রেক্ষাপট আছে। পাকিস্থান থেকে প্রাপ্ত সেনা চিন্তাধারা, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন যেটাকে মজা করে বলেন,”উপরে আল্লাহ, নীচে মিলিটারি”, যেখানে সিভিলিয়ান শাসন খুব একটা গ্রহনযোগ্য না। অনেক সেনা কর্মকর্তা সফল মুক্তিযুদ্ধা, অসম সাহসী, মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। তারমানে এই নয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ‘সিভিলিয়ান’ দেশ পরিচালনা করবে। নতুন দেশ বিনির্মানে নিজেদের অংশগ্রহণও একটা ব্যাপার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পদক বিতরনের দিকে তাকালে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। বিশেষকরে বঙ্গবন্ধু যেখানে সিভিল এবং মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি থেকে সরে আসছিলেন (স্বাধীন দেশে পরিকল্পনা কমিশন একাডেমিকদের দায়িত্ব দিয়ে, এবং এটাকে মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করে বঙ্গবন্ধু যে চেষ্টাটা করেছিলেন, সিভিল ব্যুরোক্রেটরা কিভাবে এটা নস্যাত করার চেষ্টা করেছিল, তা একটা প্রমান) তবে বর্তমান আওয়ামী লীগের সমীকরণ আলাদা। জেনারেল সফিউল্লাহ, এ কে খন্দকার, খলিলুর রহমান সবইতো আওয়ামী লীগের নেতা, যারা হয় আগে নয়ত এখনও খুব ভাল কিছু করছে না।

এটা ঠিক অনুরোধ করা সত্ত্বেও খালেদ মোশাররফ রেডিও/টিভিতে ভাষণ দেন নাই। কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধারা কেউই ‘এসে তাজউদ্দীনকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার’ ব্যাপারে কিছু বলেন নাই। যদি ধরে নেই জাতীয় নেতাদের মৃত্যুর প্রায় ৩০-৩৬ ঘন্টা পরে ৩রা নভেম্বরের নায়কেরা খবর পায়, তবে প্রশ্ন থাকে এর মধ্যে তার জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করল না কেন? (তাজউদ্দীনকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা)। প্রসঙ্গক্রমে এটাও বলে রাখি ৩ নভেম্বরের অভ্যূত্থানে সেনা কর্মকর্তা মুনিরুল ইসলাম চৌধুরিও জড়িত ছিল, যিনি তাজউদ্দীনের জামাতা ছিলেন।

হিমু এর ছবি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের একটি অবমুক্ত বার্তা (নভেম্বর ৫, ১৯৭৫ তারিখের) উইকিলিকসে প্রচারিত হয়েছে। সেটার ভাষ্য হচ্ছে, নভেম্বরের ১ তারিখ রাতেই চার জাতীয় নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হয়। বার্তাসংশ্লিষ্ট একটি পক্ষের ধারণা, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই খালেদ মোশাররফ ৩ তারিখের অভ্যুত্থান শুরু করেন।

অনেকে আবার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের জবাবে মোশতাক-মার্ডারিংমেজরস অক্ষের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই জেল হত্যাকাণ্ডকে তুলে ধরেন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

টেলিভিশনে একজন প্রাক্তন কারাগারকর্মীর সাক্ষাতকার দেখলাম, তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনা ৩রা নভেম্বরের। যিনি মামলা করেছিলেন, উপ-কারা মহাপরিদর্শক কাজী আবদুল আউয়াল, এবং জেলহত্যা মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা সবাই ৩রা নভেম্বরের কথাই বলেছেন। তাহলে কি আমরা প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষ্যদের বক্তব্য গ্রহন করবো নাকি স্যাম চাচার বক্তব্য গ্রহন করবো!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

আগে দেখিনাই। পড়লাম এবং খুবই কনফিউজড হলাম। এটা বিশ্বাস করেলে চার নেতা হত্যার আজ পর্যন্ত সব বর্ণনা মিথ্যা হয়ে যায় (তাজউদ্দিন আহমেদ মেয়েদের বিবৃতিসহ, যেখানে মৃত্যু পরবর্তি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বর্ণনাও আছে)। হত্যার সময় নিয়ে কোন বিতর্ক এখন পর্যন্ত ছিল না। এম এফ এ ডাইরেক্টর আজমত হাসানটা কে খোঁজ করি।

তখনকার আইজি, প্রিজন নুরুজ্জামান যে রিপোর্ট পাঠান (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর) সেখানে ডিআইজি প্রিজন খন্দকার আবদুল আওয়ালের রিপোর্ট সংযুক্ত ছিল, সেই রিপোর্ট অনুসারে, “ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভোর ৩টায় আমি বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের একটি ফোন পাই। তিনি আমার কাছে জানতে চান, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কোন সমস্যা আছে নাকি। আমি জানালাম, ঠিক এই মুহূর্তের অবস্থা আমার জানা নেই। এরপর তিনি আমাকে জানালেন, কয়েকজন বন্দিকে জোর করে নিয়ে যেতে কয়েকজন সেনা সদস্য জেলগেটে যেতে পারে, আমি যেন জেল গার্ডদের সতর্ক করে দেই। সে অনুযায়ী আম সেন্ট্রাল জেলে ফোন করি এবং জেলগেটে দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ডারকে ম্যাসেজটি জেলার পৌঁছে দিতে বলি, যাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।

৩/৪ মিনিট পর বঙ্গভবন থেকে আরেকজন আর্মি অফিসারের ফোন পাই।তিনি জানতে চান আমি ইতিমধ্যেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গার্ডদের সতর্ক করে দিয়েছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য জেলেগেটে চলে যেতে বলেন। আমি তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ডিয়াইজি প্রিজনকে ফোন করি। খবরটি জানিয়ে আমি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে জেলগেটে চলে যেতে বলি। দেরি না করে আমিও জেলগেটে চলে যাই এবং ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া জেলারকে আবার গার্ডদের সতর্ক করে দিতে বলি। এরই মধ্যে ডিআইজিও জেলগেটে পৌছেন। বঙ্গভবন থেকে পাওয়া খবরটি আমি আবার তাকে জানাই।

এর পরপরই মেজর রশিদের আরেকটি ফোন পাই। তিনি আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয়। এবং ১। জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, ২। জনাব মনসুর আলী, ৩। জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৪। জনাব কামরুজ্জামান – এ ৪ বন্দিকে যেন তাকে দেখানো হয়।

এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোনে প্রেসিডেন্টকে খবর দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪ জন সেনা সদস্যসহ কালো পোশাকে...”।

এই রিপোর্টের পড়ে আমার ধারনা হয়েছিল, মোশতাক-খুনিমেজর-অক্ষ অভ্যূত্থান শুরুর পরই জাতীয় চার নেতাকে অভ্যূত্থানকারীরা ছাড়িয়ে নিতে পারে এই সন্দেহ করছিল, এবং তারপর তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

১) বার্তাটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো সেটা ঢাকা থেকে প্রেরিত না হয়ে ইসলামাবাদ থেকে প্রেরিত হয়েছে। বার্তাটি পাঠাবার তারিখ বা সময়টা বোঝা যাচ্ছে না। বার্তা পাঠাবার তারিখ বা সময়টা বের করা গেলে আরেকটু স্পষ্ট হতো।

২) এখানে ১ নভেম্বর রাত বোঝাতে ২ তারিখ দিবাগত রাতকে বোঝাচ্ছে কিনা। অভ্যূত্থানের অন্যতম নায়ক শাফায়াত জামিলের(*) ভাষ্যমতে ১ তারিখ রাতে খালেদের অফিসে এই ব্যাপারে চুড়ান্ত বৈঠক হয় যে ২ তারিখ দিবাগত রাতে অভ্যূত্থান শুরু হবে। সেই মোতাবেক মেজর নাসির ও মেজর আমিনকে পাঠানো হয় ট্যাংক বাহিনীর কাছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছার পর এই দুজনের উদ্দেশ্য জানার পর তাদের আটক করা হয় এবং মেজর ফারুক তাদের মেরে ফেলার হুকুম দেন। এর অর্থ ২ তারিখ দিবাগত রাতেই ফারুক রশীদের কাছে অভ্যূত্থানের খবর পৌঁছে গিয়েছিল। সুতরাং দেরী না করে জেল হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এভাবে চিন্তা করলে ১ নভেম্বর রাতে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হবার খবরটা মিলে যায়। যেহেতু ঘটনা মধ্যরাতের পর সুতরাং ১ তারিখ পার হয়ে ২ তারিখই হবে।
[(*) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর - কর্নেল শাফায়াত জামিল]

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

একদম ওপরে তারিখ আছে তো। নভেম্বর ৫, ১৯৭৫, ০৯:৪২। এ সময়টা ওয়াশিংটন সময় কি না সেটাই প্রশ্ন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যদি ১ তারিখ দিবাগত রাতে জেলহত্যা হয়ে থাকে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদ মোশাররফ ২ তারিখ দিবাগত রাতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে থাকেন তাহলে তিনি প্রথম দফাতেই মোশতাক-ফারুক-রশীদদের খতম করতেন। কমপক্ষে তাদেরকে বন্দী করে জেলে বা ক্যান্টনমেন্টে রাখতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। তার মানে অভ্যুত্থান ঘটানোর আগে তিনি জেলহত্যার ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। আর যদি জেনেও কোন পদক্ষেপ না নিয়ে থাকেন তাহলে 'জেলহত্যার প্রেক্ষিতে অভ্যুত্থান' কথাটার কোন মানে থাকে না।

দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে তিনি জেনেশুনে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের নিরাপদে দেশের বাইরে যেতে দিয়েছিলেন, ৬ তারিখে জেলহত্যার কথা জেনেও মোশতাককে বন্দী না করে আগা মসিহ্‌ লেনে ফিরে যাবার সুযোগ দিয়েছিলেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

অবশ্য ১০ নভেম্বরে (সময় ১০১০) বোস্টারের ওয়াশিংটনে পাঠানো আগের সপ্তাহের বিশ্লেষণে ৩ তারিখ ভোরে (অথবা ২ তারিখে রাত বারোটার পর) চার নেতার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে (‘These leaders were killed, evidently at the order of one or more of the majors, early Monday morning at Dacca jail.’)। পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর সোমবার ছিল। (লিঙ্কটা পেলে পরে দিয়ে যাব)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এই আমজাদ খান চৌধুরির অধিনের কুমিল্লা ব্রিগেড (কুমিল্লা থেকে আসা ১ম আর্টিলারী রেজিমেন্টের সৈনিকরা) বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সময় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এই আমজাদ খান চৌধুরী (প্রয়াত) প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

এজন্যই পুরো নাম লিখলাম। কুমিল্লা থেকে আসা ১ম আর্টলারীর সৈনিকের সংখ্যা ১২০-১৫০ জন ছিল।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ দোতলায় জিয়ার শয়নকক্ষের পেছনের কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন। তাদেরকে কে হত্যা করলো? একটা তত্ত্ব হচ্ছে জিয়ার একান্ত সচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান বীর বিক্রম ঘাতক দল পৌঁছানোর আগেই এই দুই জনকে ও জিয়াকে হত্যা করে এবং নিজের ঘরের ভেতর নিজেই গুলি ছুঁড়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন।

অটঃ ১৯৭১ সালের ২৭শে জুলাই বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলার হেঁয়াখোতে পাকিস্তানী বাহিনীর ভারতীয় সহযোগী মিজোদের শিবিরে লেফটেন্যান্ট এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্লাটুন আক্রমণ করেন। নিজেদের চেয়ে কয়েকগুণ বড় শত্রুদলের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এই যুদ্ধ ত্রিশ মিনিটের চেয়ে কম স্থায়ী হয়। যুদ্ধে কমপক্ষে চারজন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়, এবং পাকিস্তানীদের গাড়ীগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কোন প্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ১২ মাইল দূরে নিজেদের শিবিরে ফিরে আসতে সক্ষম হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য লেফটেন্যান্ট এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানকে বীর বিক্রম উপাধীতে ভূষিত করা হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

তখনকার চট্টগ্রামে ডেপুটি কমিশনার জিয়াউদ্দিন চৌধুরির ভাষ্য সরাসরি ইংরেজিতে তুলে দিলাম (৩১ মে ১৯৮১, চিটাগাং সার্কিট হাউজ), “As I rejoined the Commissioner and other police officials in the Circuit House compound, I saw Lt Col Mahfuz coming out of the circuit house in full uniform with a wireless receiver in his hand. He stopped outside the porch, about fifty yards from us and apparently started to talk over the wireless device. We could not hear him as he was out of our hearing range. In a few minutes he joined us and somberly informed us that he had just spoken with the Chief the Army, Lt Gen Ershad as well as Home Minister, Mr Mustafizur Rahman. He also said that he had informed both that the President had been assassinated by armed intruders. Mahfuz also informed us that he had asked both the Army Chief and the Home Minister to make arrangements for taking the dead body of the President to Dhaka. According to Mahfuz, Gen Ershad was expected to arrive any moment along with the Home Minister in a helicopter.

Meanwhile, he asked that the police and the President’s guards jointly keep watch over the President’s body. He was quite calm, and unexcited. He offered no narration of the murderous attacks, nor alluded to any coup attempt that we secretly feared. He simply stated that the intruders had fired into his room, but he escaped since he was hiding under the bed! (He later showed us the bullet marks, all of which were on the back wall with none on the door!).

Mahfuz’s calm demeanour and the unruffled statement that he had spoken with both Gen. Ershad and the Home Minister, and both of them on their way to Chittagong puzzled us to no end.

[জিয়াউর রহমান হত্যার পরপরই ঢাকা-চট্টগাম টেলিফোন যোগাযোগ কোন বিচিত্র কারণে বিছিন্ন হয়ে যায়।

নাদির জুনাইদ এর ছবি

কর্নেল মাহফুজ সার্কিট হাউসে আক্রমণকারীরা পৌঁছার আগেই কর্নেল আহসান, ক্যাপ্টেন হাফিজ আর প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছিল এই ধারণাটি কারা দিয়েছে? কর্নেল মাহফুজ তার নিজের ঘরে গুলির দাগ দেখিয়েছে এটা সরকারি ভাষ্যে বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সেই দাগগুলো মাহফুজ হয়তো নিজেই করেছে। কিন্তু মাহফুজ যদি ওই তিনজনকে হত্যা করে একাই তাহলে জিয়ার গার্ডরা তো গুলির শব্দ শুনে ছুটে আসতো। আর এক দল গার্ড রেজিমেন্টের সৈনিককে মাহফুজ একা মোকাবেলা করতে পারতো কি? আর মাহফুজকে এমন নির্দয়, ঠান্ডা মাথার খুনী বলেও মনে হয় না।

জিয়া হত্যার পর মাহফুজকে কিন্তু বন্দী করেই রাখা হয়েছিল যা থেকে বোঝা যায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তাকে আস্থায় নেয়া হয়নি। মনজুরের পতনের পর মাহফুজ ঢাকা যেয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ক'দিন আগেই কর্নেল মতি ঢাকায় এসে এরশাদসহ আরো অনেকের সাথে কী কথা বললো। তারপরই মাহফুজকে বন্দী করা হয়। বন্দী করার পর তাকে হেভি টর্চার করা হয়েছিল যা বন্দী অফিসারদের পক্ষের আইনজীবীরা দেখেছিলেন। তার হাতের নখ সব উপড়ে ফেলা হয়েছিল। মাহফুজ একাই তিনজনকে আক্রমণকারীরা সার্কিট হাউসে আসার আগেই হত্যা করেছিল এই তত্ত্ব যারাই দিয়ে থাকুক তা যৌক্তিক মনে হয় না।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এসব ধারণা কারা তৈরী করে সেটা কখনো জানতে পারবেন না। হাওয়ায় ঘোরা নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মতো এটাও একটা তত্ত্ব। তবে এখানে এটা বলা হয় না তাহলে কর্নেল মাহফুজ কার হয়ে এসব করেছিলেন।

ঘরের ভেতরের গুলির দাগ, কর্নেল মাহফুজের ব্যক্তিগত রিভলবারের গুলির বোরের সাথে তার মিলে যাওয়ার খবর ঐ সময়েই পত্রপত্রিকায় এসেছিল। পত্রপত্রিকার এই ভাষ্যের উৎস তৎকালীন সরকার কিনা তা জানি না।

শুধু কর্নেল মাহফুজ না, বন্দী সব অফিসারকেই অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল। ১১/১৯৭৫ থেকে ০৫/১৯৮১ পর্যন্ত ঘটা সব অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় বন্দী অফিসার ও সৈনিককে মৃত্যুদণ্ড দেবার আগে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

Muttakin sarker এর ছবি

সম্পূর্ণ মিথ্যা ও মনগড়া একটি তথ্য। মাহফুজ কে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং হাজার 981 সালের 23 শে সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার অপরাধ ছিল তিনি ঢাকায় এসে এরশাদকে মূল ঘটনার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং এরশাদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর কে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিজের সাথে একটি গোপন বৈঠক করেন

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পঁচাত্তরের ঘটনাবলী যতবারই বিশ্লেষণ করি ততবারই একটা ব্যাপার খচখচ করে। সেটা খালেদ মোশাররফ। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধা অর্জন করা এই সুসংগঠিত আত্মবিশ্বাসী মানুষটি পঁচাত্তরে এসে কেমন এলোমেলো হয়ে গেলেন। ১৯৭৫ এর আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়কালে তাঁকে বুঝতে অক্ষম হই। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর তাঁকে মর্মাহত মনে হয়নি। ৩ নভেম্বরের অভ্যূত্থানের পর তিনি ছিলেন বিশৃংখল, অসংলগ্ন, খামখেয়ালীপূর্ণ একজন সেনাপতি। সেনাপ্রধানের পদ পাওয়ার জন্য তিনি লক্ষ্যচ্যুত হয়েছিলেন? কিছুতেই মানা যায় না বঙ্গভবনে তাঁর খেলো অবস্থান। মোশতাকের হাতে কেন সেনাপ্রধানের ব্যাজ পরতে হবে? তিনি এবং শাফায়াত চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর চেইন অব কমাণ্ড ফেরাতে। সে কারণে ১ নভেম্বর থেকে অভ্যূত্থানপর্বের সূচনা করেন। কিন্তু চেইন অব কমাণ্ড ফেরাতে হলে যে দক্ষ, সতর্ক এবং কঠোর মানসিক অবস্থানটা দরকার ছিল, তার কিছুই উপস্থিত ছিল না তাঁর মধ্যে। তারপর নিজের ব্রিগেডের হাতে মৃত্যুবরণ করা কোনটাই মেনে নেয়া যায় না। তাঁর নিজের ব্রিগেডের চেইন অব কমাণ্ড ঠিক আছে কিনা সেটা আগে জেনে তারপর গোটা সেনাবাহিনীর চেইনের দিকে তাকানো দরকার ছিল।

১৯৮১ সালের পুরো খেলাটা এরশাদ এক হাতে খেলেছে। এ যাবতকালের সব সামরিক খেলোয়াড়ের মধ্যে এরশাদই চ্যাম্পিয়ান। গড ফাদার যাদের দেখা আছে তাদের কাছে এরশাদের খেলাটা অনেক বেশী পরিষ্কার। খুন করতে পাঠিয়ে কাজ শেষে খুনীকে নিকেশ করে দেবার দক্ষতাই তার যোগ্যতা। পঁচাত্তরের মতো এখানে খুব বেশী জটিল সমীকরণ ছিল না। তাই ১৯৮১ সালের পর আর তেমন বড় কোন সামরিক খেলা হয়নি প্রকাশ্যে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

ঘটনাচক্রে জিয়া ও মঞ্জুরকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমি চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টে মঞ্জুরের অফিশিয়াল কোয়ার্টারের দুয়েকটি বাড়ি পরেই ছিলাম। না, বিশেষ কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ছে না শুধু মিলিটারি ট্রাকের আসা যাওয়া ছাড়া। তবে ওখানেই থাকা আমার সমবয়সী এক কাজিনের দাবী সে হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে কাছেই অফিসার্স মেসে নিয়ে সাময়িক ভাবে কার যেন লাশ রাখতে দেখেছে দূর থেকে (মঞ্জুর মনে হয়, তবে স্পষ্ট মনে নেই কার কথা বলেছিল), আর মিসেস মঞ্জুরকে কান্নাকাটি করতে দেখেছে বাইরে থেকে। সত্যি না চাপা জানি না। নাটকীয় ঘটনার মধ্যে শুধু একটাই মনে পড়ছে - ঢাকা থেকে নাকি বিদ্রোহীরা আত্নসমর্পণ না করলে বম্বিং করার হুমকি দেয়া হয়েছিল, তখন "নিউট্রাল জোন" বলে কথিত সামরিক অফিসার্স মেসে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম এবং সারারাত সবাই নির্ঘুম কাটিয়েছিলাম। সত্যিকার তুমুল এরিয়াল বম্বিং-এর শিকার এর আগে হয়েছি, ফলে পরিবেশটা ডেযা ভ্যু-র মতো লাগছিল খানিকটা। অবিশ্বাস্যও লাগছিল ভেবে যে এবারে হুমকিটা আসছে নিজেদের পক্ষ থেকে নিজেদেরই বিরুদ্ধে। কি ট্রাজেডি!

ঐ বছরেই ('৮১) ঢাকা থেকে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টের সীমানাভূক্ত চিটাগাং ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও তার হোস্টেলে রেসিডেন্ট ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলাম। ভর্তি হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই (ফেব্রুয়ারীতে মনে হয়) স্বয়ং মঞ্জুরকেই দেখলাম - আমাদের স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টসের অনুষ্ঠানে। ক্যান্টনমেন্টের জিওসি এবং স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে তিনিই ছিলেন প্রধান অতিথি, এবং আমরা তার সামনে দিয়ে স্যালুট দিয়ে মার্চ পাস্ট করে গিয়েছিলাম। এরই দু-তিন মাস পরে জিয়া হত্যার ঠিক ঐ সময়েই অসুস্থ অবস্থায় মঞ্জুরেরই দুয়েক বাসা পরে এক সেনা আত্নীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম সিএমএইচে। তারপরেই এই ঘটনা...

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

****************************************

নৈষাদ এর ছবি

পঁচাত্তরের ২০ শে আগস্ট মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের সাথে প্রেসিডেন্ট হিসাবে মোশতাকের বঙ্গভবনে প্রথম মিটিং এর যে বিবরণ বোস্টার তারবার্তায় ওয়াশিংটনে পাঠান, তার ‘আবেগঘন’ কিচু অংশ সরাসরি ইংরেজিতে তুলে দিলাম, “…Although I had taken political counselor with me, president asked that we meet privately. He began by inquiring when I was leaving for Washington (I had told him at dinner before the coup last week that I was returning at the end of this month for selection board duty). I told him that I had just been informed that this duty had been cancelled and that I should remain in Dacca. He said he was delighted and that he had expected it.
He then spoke with great earnestness, repeatedly clasping my hand, of his need for us to help him restore normalcy in the country. He said he had not yet developed an agenda of his needs but we must not lose the opportunity today which we had lost in 1971, referring me to our conversation last May in which he had mentioned unsuccessful efforts in which he had been involved with US officials in Calcutta to reach a compromise between East and West Pakistan.....”

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এই বিষয়ে আলোচনা কোনোদিন শেষ হবে না। পোস্ট আর মন্তব্যগুলো পড়ে নতুন কিছু চিন্তা মাথায় ঢুকলো কেবল। এবার আবার নতুন করে পড়ার শুরু

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পড়ার জিনিস খুব লিমিটেড। বোধ করি সেগুলোর কোনটা আর আপনার পড়ার বাকি নেই। ঐ আমলের সরকারী কাগজপত্র, ভাষ্য, শ্বেতপত্র, মামলার নথি এবং তার সাথে হুজুরদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা তাদের দেশের সদর দপ্তরে যেসব তারবার্তা পাঠাতেন সেগুলো ঘাঁটতে পারলে নতুন সত্য জানার একটা সম্ভাবনা আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সোহেল ইমাম এর ছবি

লেখাটা একটা বইয়ের আকার পেলে বেশ হতো। সেরকম কোন পরিকল্পনা আপনার আছে কি?

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।