প্লেটোর ইউথিফ্রোঃ পবিত্রতার স্বরূপ

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০১/২০২৩ - ৪:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এ পৃথিবীতে কিছু কাজ কেন পবিত্র আর কিছু কাজ কেনই বা অপবিত্র? কারো কাছে বেকন বা সসেজ খেতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু সেই একই খাবার কোন কোন সম্প্রদায়ের কাছে ভীষণ 'অপবিত্র'; খেলে নরকবাস নিশ্চিত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক গরুকে পবিত্র 'গোমাতা' হিসেবে পূজা করেন, আবার সুনাকের ভোটার অনেকেই সেই গরুকে জবাই করা 'পবিত্র কাজ' সাব্যস্ত করে কেটেকুটে খেয়ে ফেলেন। কিন্তু একই কাজ যদি কারো কাছে পবিত্র আর কারো কাছে ভিত্তিহীন বা অপবিত্র হয়, তবে এগুলোকে 'পবিত্র' বা 'অপবিত্র' হিসেবে মেনে নেয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, যা এখনও প্রাসঙ্গিক।

সক্রেটিসের এই প্রশ্নের পটভূমিতে একটা মজার গল্প আছে। তার আগে বলে নেয়া ভালো বা অনেকেরই জানা, সক্রেটিস যেহেতু কিছু লিখে যাননি, তাঁর সম্পর্কে আমরা যা জানি তা মূলতঃ তাঁর দুই শিষ্য প্লেটো ও জেনোফনের বরাতে। এদের মধ্যে জেনোফন ছিলেন ইতিহাসবিদ, তাঁর বর্ণনার ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। অন্যদিকে প্লেটোর রচনাগুলি মূলতঃ শিক্ষামূলক। সক্রেটিস যেভাবে প্রশ্ন উত্থাপন এবং কথোপকথনের মাধ্যমে কোন বিষয়ের গভীরে যেতেন, একাডেমিয়ায় তা 'সক্রেটিক মেথড/পদ্ধতি' নামে পরিচিত। প্লেটো তাঁর গুরু সক্রেটিস সম্পর্কে লেখাগুলোতেও সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন যা 'ডায়লগস' (Dialogues) নামে বিখ্যাত। আনুমানিক ৩৫টি ডায়ালগ প্লেটো লিখেছিলেন যার বেশিরভাগের প্রধান চরিত্র সক্রেটিস। সক্রেটিসের পবিত্রতা (piety/holiness) সম্পর্কিত ঘটনা ও কথোপকথন নিয়ে প্লেটো লিখেছিলেন তাঁর ডায়লগ 'ইউথিফ্রো'

ইউথিফ্রোর এই ঘটনা যে সময়ের, তখন এথেন্সের তরুণদের বিপথে চালিত করা ও দেবতাদের নামে বিষোদগার করার জন্য সক্রেটিসের নামে আদালতে শমন জারি হয়েছিলো। সক্রেটিস তাঁর বিদ্যাপীঠ লাইসিয়াম থেকে যাচ্ছিলেন আদালতে হাজিরা দিতে। পথিমধ্যে দেখা ইউথিফ্রোর সাথে। ইউথিফ্রোও আদালতে যাচ্ছিলেন তার পিতাকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার তদবির নিয়ে। ইউথিফ্রোর পিতা তাদের খামারে এক ভৃত্যকে বন্দী করে রেখেছিলেন খামারের এক দাসকে রাগের মাথায় হত্যা করার জন্য। এরপর শহরে পুরোহিতের কাছে একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন ভৃত্যটিকে কী করা উচিত তা জানার জন্য। এ সময় ভৃত্যটিকে কোন খাবার না দিয়ে হাত-পা বেঁধে গর্তে ফেলে রাখা হয়েছিলো। বার্তাবাহক যখন পুরোহিতের কাছ থেকে ফিরে আসলো, ততদিনে অনাহারে ও ঠাণ্ডায় ভৃত্যটির মৃত্যু হয়েছিলো। ইউথিফ্রোর দাবী তার পিতার অবহেলার কারণে ভৃত্যটির মৃত্যু হয়েছে, তাই তারও মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত এবং এটাই সঠিক ও পবিত্র কাজ।

ইউথিফ্রোর বয়ান শুনে সক্রেটিসের কাছে তার দাবীটিকে বেশ জটিল মনে হলো দু'টো কারণে। প্রথমত, ইউথিফ্রোর পিতার কাস্টডিতে ভৃত্যটির মৃত্যু হয়েছিলো- এটুকু ছাড়া ইউথিফ্রোর পিতার আর কী দোষ ছিলো সেটা ঠিক পরিস্কার না। এখানে উল্লেখ্য, তখনকার দিনে ভৃত্য ও দাসদের মানবাধিকার বলে কিছু ছিলো না। কাজেই তাকে খাবার না দিয়ে ফেলে রাখাটা এখনকার যুগে আমরা মেনে না নিলেও, তখন সেটা স্বাভাবিক ছিলো। দ্বিতীয়ত, সন্তান হয়ে পিতার শাস্তি চাওয়ার মধ্যে কেমন যেন একটু অস্বাভাবিকতা আছে, বিশেষ করে যেখানে ইউথিফ্রো একদম নিশ্চিত এটাই সঠিক ও পবিত্র কাজ। সক্রেটিস ইউথিফ্রোকে বললেন, সে যদি এতই নিশ্চিত তবে তার নিশ্চয়ই পবিত্রতা (piety) সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা আছে। অতএব, সক্রেটিস ইউথিফ্রোকে আহবান করলেন পবিত্রতা ও অপবিত্রতা সম্পর্কে ব্যাখা দেয়ার জন্যে। এভাবেই ডায়লগটি বিস্তার হলো। আমরা এখানে সংক্ষেপে ইউথিফ্রো কী ব্যাখা দিয়েছিলো এবং সক্রেটিস কীভাবে খণ্ডন করেছিলেন তা জানার চেষ্টা করবো।


ছবিসূত্রঃ ন্যাশনাল গ্যালারি অফ স্লোভেনিয়া

ক) ইউথিফ্রোর প্রথম ব্যাখাঃ পবিত্রতার উদাহরণ

ইউথিফ্রো প্রথমে বললেন, পবিত্র ও অপবিত্র কাজ হলো সেগুলো যা তিনি ও দেবতারা করেন এবং যা থেকে বিরত থাকেন। যেমন- তিনি এখন ভুল কাজ যে করেছে তাকে শাস্তি দিতে চলেছেন, হোক সেটা তার বাবা, মা বা অন্য কেউ। তাকে শাস্তি না দেয়াটাই হবে অপবিত্র কাজ। ইউথিফ্রো দেবরাজ জিউসের উদাহরণ দিলেন যিনি তার পিতা ক্রোনোসকে শাস্তি দিয়েছিলেন সন্তানদের খেয়ে ফেলার জন্যে, এবং ক্রোনোসও তার পিতা ইউরেনাসকে অনুরূপ কাজের জন্য শাস্তি দিয়েছিলো। কাজেই তিনি একাই তার পিতার শাস্তি এখানে চাচ্ছেন না। এরকম অসংখ্য উদাহরণ গ্রীক ধর্মেই আছে।

সক্রেটিস ইউথিফ্রোর এই গোঁজামিল দেয়া উদাহরণে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বললেন, আমি তোমাকে এইরকম একটা-দু'টো পবিত্র কাজের উদাহরণ দিতে বলি নাই। আমি জানতে চেয়েছি, কীসের ভিত্তিতে কোন কাজ পবিত্র বা অপবিত্র হিসেবে গণ্য হবে। সক্রেটিস আশা করেছিলেন, ইউথিফ্রো কোন একটা সংজ্ঞা বা নিয়ম বলবে যার ভিত্তিতে কোন কাজকে পবিত্র বা অপবিত্র হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে।

খ) ইউথিফ্রোর দ্বিতীয় ব্যাখাঃ দেবতাদের কাছে যা প্রিয়

ইউথিফ্রো এরপর যুক্তি দিলেন, দেবতাদের কাছে যা প্রিয় তাই পবিত্র এবং তাদের কাছে যা অপ্রিয় তা অপবিত্র। সহজ যুক্তি। কিন্তু সক্রেটিস পালটা যুক্তি দিয়ে বোঝালেন, ইউথিফ্রো যে গ্রীক দেবতাদের বিশ্বাস করে তারা নিজেরাই এক অপরের সাথে সারাক্ষণ কলহ ও যুদ্ধ করে তাদের প্রিয় জিনিস নিয়ে। কাজেই একই কাজ কোন দেবতার কাছে প্রিয় তথা পবিত্র এবং অন্য দেবতার কাছে অপ্রিয় তথা অপবিত্র হতে পারে। ইউথিফ্রোও সক্রেটিসের সাথে একমত হলো।

বর্তমানে প্রচলিত ধর্মগুলির ক্ষেত্রেও একই যুক্তি দেয়া যায়। গ্রীক ধর্মে যেমন দেবতারা কলহ-বিবাদে লিপ্ত হতেন, তেমনি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা তো বটেই নিজ ধর্মের লোকজনও একে অন্যের সাথে দ্বন্দ্বে নেমে পড়ে। আমেরিকায় যেমন ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে প্রতিবছর গণ্ডগোল হয়। একদল লোক মনে করে চাঁদ চাক্ষুষ দেখে নামাজ পড়া পবিত্র কাজ, বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশে কোন বরকত নেই। বাংলাদেশে বেশিরভাগ লোকের কাছে মিলাদ পড়া খুবই পবিত্র কাজ, কিন্তু অনেকের কাছে বিদা'আত। আর খাবারের উদাহরণ তো শুরুতেই দিয়েছি- এক সম্প্রদায়ের কাছে যা পবিত্র খাবার, অন্য সম্প্রদায়ের কাছে তা অপবিত্র।

গ) ইউথিফ্রোর তৃতীয় ব্যাখাঃ সব দেবতারা যা ভালোবাসে

এরপর ইউথিফ্রো ব্যাখা দিলো, সব দেবতারা যা ভালোবাসে তাই পবিত্র, সব দেবতারা যা ঘৃণা করে তাই অপবিত্র। ইউথিফ্রোর যুক্তি শুনে সক্রেটিস এখানে তাঁর বিখ্যাত প্রশ্নটি করলেন, "Is the pious being loved by the gods because it is pious, or is it pious because it is being loved by the gods?” অর্থাৎ কোন কিছু পবিত্র বলেই কি দেবতারা তা ভালবাসেন নাকি দেবতারা ভালবাসেন বলেই সেটা পবিত্র? দেবতারা যদি কোন জিনিস পবিত্র বলেই ভালোবাসেন, তবে দেবতার ভালোবাসা ছাড়াই সেটা আগে থেকে পবিত্র। সক্রেটিসের প্রশ্নের প্যাঁচ খেয়ে ইউথিফ্রো আরও কনফিউজড হয়ে গেলো, তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

ঘ) ইউথিফ্রোর চতুর্থ ব্যাখাঃ পবিত্রতা ন্যায়বিচারের অংশ

ইউথিফ্রো এরপর যুক্তি দিলো, পবিত্রতা হলো ন্যায়বিচারের একটা অংশ যার সাথে দেবতারা সংযুক্ত বা দেবতাদের এর মাধ্যমে কেয়ার বা সেবা করা হয়। সক্রেটিস প্রথমে বুঝতে চাইলেন, 'কেয়ার অফ' বলতে ইউথিফ্রো এখানে কী বোঝাতে চাইছেন। কারণ, আমাদের কোন পবিত্র কাজের মাধ্যমে আমরা কোন দেবতা বা স্রষ্টার টেইক কেয়ার বা কোন উপকার করতে পারি না। একটু চাপাচাপি করার পর ইউথিফ্রো স্বীকার করলেন, তিনি আসলে এখানে ক্রীতদাসরা যেমন মনিবের টেইক কেয়ার করে তা বোঝাতে চাইছেন। সক্রেটিসের কাছে এই যুক্তিটাও কনভিন্সিং মনে হলো না। স্রষ্টা দ্বারা আমরা উপকৃত হতে পারি, কিন্তু আমাদের কাজ দ্বারা স্রষ্টা কীভাবে উপকৃত হবেন তা বোধগম্য নয়। বিশেষ করে, যিনি ওমনিপোটেন্ট, ওমনিবেনেভোলেন্ট, তাঁর কেন মানুষের ক্ষুদ্র কাজ নিয়ে এত মাথাব্যথা থাকবে- যুগ যুগ ধরে সক্রেটিসের মতো দার্শনিকরা এই প্রশ্ন তুলে গেছেন।

ঙ) ইউথিফ্রোর পঞ্চম ব্যাখাঃ দেবতাদের কাছে যা প্রিয়

ইউথিফ্রো অবশেষে ক্ষান্ত দিলেন এই বলে, যেসব জিনিস দেবতাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় তাই পবিত্র। সক্রেটিস তাকে বললেন যে এই যুক্তি সে শুরুতেই দিয়েছিলো। কাজেই তাদের আবার নতুন করে যুক্তিতর্ক শুরু করতে হবে। ইউথিফ্রো হতাশ হয়ে বললেন, তার তাড়া আছে, এখন তাকে যেতে হবে।

প্লেটোর 'ইউথিফ্রো' ডায়লগের এখানেই পরিসমাপ্তি; যার মাধ্যমে 'পবিত্রতার' আদ্যোপান্ত ঘেঁটে সক্রেটিস দেখিয়েছিলেন যে এর আদৌ কোন ভিত্তি নেই। আয়রনির ব্যাপার হলো, তৎকালীন যে গ্রীক ধর্মের উদাহরণ এখানে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিলো, তা এখন মিথলজিতে পরিণতি হয়েছে। কিন্তু সেই পবিত্র আর অপবিত্রতার কংকাল আমরা প্রচলিত ধর্মের মাধ্যমে আজও টেনে চলেছি। হয়ত আরও আড়াই হাজার বছর পরে সেই কংকাল আমরা চাপা দিতে পারবো।

ছবি: 
31/10/2007 - 3:50পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

মন মাঝি এর ছবি

লেখাটায় ব্যবহৃত কী-টার্মটার অনুবাদ কনসেপচুয়ালি ইকুইভ্যালেন্ট হয়নি। সোজা বাংলায় ভুল হয়েছে। ডিসক্রেপ্যান্ট অনুবাদের ফলে যুক্তিতর্কগুলি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে বাংলায়। যদিও ব্র্যাকেটে ইংরেজিটা দেয়ার ফলে বোঝা গেছে শেষ পর্যন্ত।

প্রাচীণ গ্রীক ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে করা সক্রেটিস-ইউথিফ্রোর এই তর্কের প্রেক্ষণীর ভিতর দিয়ে হাজার বছর পরের একেশ্বরবাদী সেমিটিক বা অন্যান্য ধর্মের (বা ভাইসে-ভার্সা) বিশ্বাস, তত্ত্ব বা যুক্তিতর্কগুলি নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব বলে মনে হয় না মৌলিক কনসেপচুয়াল / তাত্ত্বিক পার্থক্যের কারনে। বিষয়টা বিভ্রান্তিকর ও গোজামিল হয়ে যায়।

****************************************

তানভীর এর ছবি

আপনি হয়ত piety এর বাংলা 'ধার্মিকতা' হিসেবে ভাবছেন তাই অনুবাদে অসঙ্গতি মনে হচ্ছে। এটা যে গ্রিক শব্দ থেকে অনূদিত হয়েছে সেটা piety বা holiness দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। আমার কাছে বাংলায় এখানে ধার্মিকতার চেয়ে পবিত্রতা উপযুক্ত শব্দ মনে হয়েছে। ধার্মিকতা কোন কাজের চেয়ে ব্যক্তিবিশেষকে নির্দেশ করে- কেউ ধার্মিক বা অধার্মিক ইত্যাদি। কিন্তু এখানে কোন ব্যক্তি নয়, বরং কাজের পবিত্রতা/অপবিত্রতা বা পাপ-পূণ্যকে বোঝানো হয়েছে। আর, আড়াই হাজার বছর আগের ধর্মে যে যুক্তি প্রয়োগ করা গিয়েছিলো, এখনকার একেশ্বরবাদী ধর্মে তার যৌক্তিকতা নেই বলছেন? আপনার বক্তব্য পরিস্কার বোঝা গেলো না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।