পল্লীকবি জসীম উদদীনের যুগোস্লাভিয়া ভ্রমণ

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: সোম, ০৬/০৭/২০২০ - ৯:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে পল্লীকবি জসীম উদদীন আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীতের মহাসভার অধিবেশনে অংশ নেবার আমন্ত্রণে সাবেক যুগোস্লাভিয়া ভ্রমণ করেন, এবং সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘হলদে পরীর দেশে’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। সেই বই পড়েই মনে হল এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের জানা থাকার দরকার।

বইয়ের প্রথমেই দেখা য্যা পল্লীকবি ম্যাপ ও ভূগোলের বই নিয়ে যুগোস্লাভিয়ার অবস্থান সেখানের রাজধানী ও অন্যান্য বড় শহর বন্দর ইত্যাদি খুঁজছেন এবং সেখানে সুন্দর করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অসাড় অবস্থার সমালোচনা করছেন,

“ শুধুমাত্র নতুন নতুন নামে ভূগোলের বই ভর্তি। এত সর্বনাম শব্দ মুখস্থ করিতে হইত বলিয়াই ছোটবেলায় ভূগোল বইখানা আমার কাছে মাষ্টার মহাশয়ের কঠিন বেতের চাইতেও ভয়ংকর বলিয়া মনে হইত। দেশের লোকজন কথা বলিয়া, তাহার আবহাওয়ার কাহিনী বর্ণনা করিয়া ভূগোলের বইকে শিশুদের হৃদয়গ্রাহী করিবার ইচ্ছা কোনো পাঠ্যবই-লেখকেরই দেখি না। সে আমাদের দেশের পাঠ্যবইগুলি নতুন করিয়া গড়িয়া তুলিবে?’

যাত্রার প্রথম কবি করাচী যান এবং সেখানে বাংলার যশোর জেলায় বাড়ি এক পাগলা কিসিমের শিল্পীর সাথে তাঁর পরিচয় ও সখ্য ঘটে, শিল্পীর নাম ‘এস এম সুলতান’। করাচীতে সুলতানের বোহেমিয়ান জীবন , তাঁর শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা , স্থানীয় বন্ধুজগত ইত্যাদির সংক্ষিপ্ত বিরল বর্ণনা আমাদের আলোকিত করে এইখানে।

এরপর কবি বিমানে ইতালির রোম যেয়ে সেখানে কদিন থেকে স্থলপথে ভেনিসের কাছের ত্রিয়েস্ত নগরী গমনে করে সেখান থেকে যুগোস্লাভিয়া প্রবেশ করেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে ঝরঝরে ভাষায় লোকসঙ্গীতের মহাসভার নানা অনুষ্ঠানের বিবরণ এবং নানা দেশের সঙ্গীতের সাথে বাংলার লোক সঙ্গীতের মিল-অমিল, তুলনামূলক আলোচনা ইত্যাদির আলাপ করে গেছেন কবি। এবং উনার এক ভাষণে তিনি বাংলা নিয়ে বলেন -

“আমাদের পূর্ব বাঙলা। ব্রহ্মদেশ আর ভারতের মাঝখানে সমতল প্রদেশ। নব আকাশের নীলঘন মেঘের সঙ্গে আড়াআড়ি করেই বুঝি এর মাঠগুলি সবুজে সবুজে ছেয়ে ফ্যালে। সেকী অপূর্ব সবুজ, ফিকে সবুজ, গাঢ় সবুজ, সবুজে নীলে মেশা সবুজ, আমপাতা সবুজ, ধানপাতা সবুজ, আসমানি সবুজ, গঙ্গা-যমুনা সবুজ। মাঠের পরে মাঠ, কোথাও সুদূর আসমানের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে, কোথাও সবুজ বনানীর মধ্যে যেয়ে পথ হারিয়েছে। সেই নানা বর্ণের সবুজ মাঠের মধ্যে আমাদের গ্রাম্য চাষিদের ছোট ছোট ঘরগুলি। বাড়ির এধারে-ওধারে আম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেলের বাগান। তাও আমরা সবুজ করে রেখেছি। সবুজকে আমরা এত ভালোবাসি! আমাদের আকাশে মেঘের সবুজ, বনে-বনে গাছের পাতার সবুজ, মাঠে শস্যক্ষেতের সবুজ, বাড়িতে আম-কাঁঠাল, শাকসবজির সবুজ। সেই সবুজ আমাদের গায়েও মরা কতকটা মেখে নিয়েছি। আমাদের দেশের নায়কের শ্যামল মুখের কতই-না শোভা আমাদের কবি বর্ণনা করেছেন।“

অনুষ্ঠান শেষে কবি রাজধানী বেলগ্রেডে যান, যাত্রাপথের নানা বিবরণে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা ও শিশুদের মনোজগতের প্রতি তাঁর ব্যপক কৌতূহল প্রকাশ পায় নানা প্রশ্ন ও ধারাবিবরণীতে।

বেলগ্রেডে থাকা অবস্থায় কবি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শিশুদের বেশ কটা স্কুল , শিশু বেটার কেন্দ্র ইত্যাদি ভ্রমণ করেন এবং যুগোস্লাভিয়ার শিশুদের সাথে কাটানো নির্মল অভিজ্ঞতা যে তাকে কী পরিমাণ ঋদ্ধ করেছে তা উল্লেখ করেন। সেই সাথে প্রায়ই উল্লেখ করেন যুগোস্লাভিয়ার কারিগর, প্রবল প্রতাপশালী মার্শাল টিটোর কথা। টিটো যে তখনের যুগোস্লাভিয়ায় কি পরিমাণ জনপ্রিয় এবং গণমানুষের মনে বিশেষ করে দরিদ্রদের মনে তাঁর আসন কতটা দৃঢ় সেই সব অভিজ্ঞতা লিখেছেন উনার অভিজ্ঞতা থেকে।

( যদিও সেগুলো অনেকটায় ভাসা ভাসা মনে হয়েছে, একেবারে প্রান্তিক মানুষের সাথে, বা আমজনতার সাথে কবির সংযোগ ঘটে নি, সরকারি লোকজনের সাথেই থাকতে হয়েছে বা ছিলেন সবসময়ই। সেই সাথে ভাষাগত সমস্যা তো ছিলই।“ )

স্থানীয় তরুণী রডমিলার সাথে মিষ্টি বন্ধুত্ব ও তাকে নিয়ে কবিতা লেখার স্মৃতি বর্ণনা করতে করতে কবি সারায়েভো চলে আসেন প্লেনে চেপে ( বর্তমান বসনিয়া-হারজেগোভিনার রাজধানী) , সেখানে মুসলিম পণ্ডিত ও উলামা সমাজের সাথে পরিচয়ের ঘটনাবলীর পাশাপাশি স্থানীয় অনুবাদকদের সাথে নানা অভিজ্ঞতা বিশেষত তাঁদের ব্যক্তিগত প্রেমকাহিনির সুন্দর মিশেল দিয়ে কবি ফের বেলগ্রেডে ফিরে যান।

যুগোস্লাভিয়া ভ্রমণের এক ফাঁকে কবিকে দেখা যায় সেখানের চমৎকার নিসর্গবান্ধব নগর পরিকল্পনার সাথে তুলনা করে ঢাকার বিশেষত কমলাপুর অঞ্চলের সুন্দর সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস করে যত্রতত্র কুৎসিত ভবন নির্মাণের ও গাছ কাটার সমালোচনা করতে।

বইয়ের শেষাংশে কবি জাগরেবে ( বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী) আসেন, এবং এখানে নানা সমবায় গ্রাম ভ্রমণের সময় স্থানীয় কৃষকদের সাথে মত বিনিময় করে যুগোস্লাভিয়ার এই গ্রাম ব্যবস্থা যে উপমহাদেশের চেয়ে অনেক বেশী জনহিতকর এমন একটা চিন্তার খোরাক তিনি পাঠককে দিয়ে যান আলগোছে। সেখানেও নানা স্থানীয় বন্ধুর সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে এক দল জিপসির সাথে তাঁর আলাপ হয়, এমনকি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানেও তিনি অংশ নেন।

এই সবেরই এক সুন্দর বর্ণনা ১০৯ পাতার ‘হলদে পরীর দেশে’। বইটা প্রকাশ করেছে পলাশ প্রকাশনী, দাম ১৭০ টাকা। বইতে কবির যুগোস্লাভিয়ার কিছু আলোকচিত্রও আছে।

সেই সময়ের অভিজ্ঞতা হিসেবে পড়ে দেখা যায়, খুব গভীরে যাবার মত উপাত্ত নেই, বা নেই স্লাভিক জাতিসত্তা ও তাঁদের সংগ্রামের গল্প বা টিটোর সময়ের আগের যুগোস্লাভিয়ার গল্প। তবুও ১৯৬৫ সালের আগের অভিজ্ঞতা হিসেবে এটি আমাদের ভ্রমণসাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বই বলেই বিবেচিত হবে আমার মনে হয়।

(সেই যুগোস্লাভিয়া আজ ৭ দেশে বিভক্ত- সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রা, বসনিয়া-হারজেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, মেসেডোনিয়া, কসোভো, স্লোভেনিয়া। কবি এখন গেলে সাবেক যুগোস্লাভিয়াকে কিভাবে দেখতেন সেটা নিয়ে চিত্তাশীল আলোচনা করা হতে পারে। উল্লেখ্য বলকানের এই ৭ দেশই নানা পর্যায়ে একাধিক বার করে ভ্রমণ হয়েছিল, সেখানে জনগণ, প্রকৃতি, বন্ধুদের নিয়ে আলাদা ভাবে বই লেখার মৃদু পরিকল্পনা যে নেই তা নয়, কিন্তু ঐ অঞ্চলের চলমান বিভেদ ও যুদ্ধের রাজনীতির গভীরে যেয়ে বলকান অঞ্চলের জনছবি আঁকা বাস্তবিক অনেক বেশী সময় ও পরিশ্রমের কাজ। )

ছবি: 
07/07/2011 - 11:39অপরাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

যুগোস্লাভিয়া সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই বললেই চলে তবে এমির কুস্তুরিকার আন্ডারগ্রউন্ড (১৯৯৫) ছবিটা দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যুগোস্লাভিয়া নিয়ে কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম। মনে দাগ ফেলেছিল অসাধারণ এই ছবিটা, সারিয়ালিজম আর বাস্তবতার একটা মোহনীয় সমন্বয়। কমলাপুরে কবির যে বাড়িটি রয়েছে তার সামনে দিয়ে বেশ কয়েকবারই গিয়েছি, তাঁর নামেই সেখানের সড়ক। '৬৪ সালেই তিনি সেখানের নিসর্গ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন, জানিনা আজকের কমলাপুরের প্রাকৃতিক নিসর্গ (!) দেখে কবি কী মন্তব্য করতেন। বলকান রিজিওন নিয়ে লিখবেন আশা করি।

- লে নিহিলিস্ট

তারেক অণু এর ছবি

দেখে আর ফিরতেন না! শুভেচ্ছা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সময় ও পরিশ্রমের অপেক্ষায় পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

এত পপ্পন খাইলে মোটা হয়ে যাবেন তো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।