'যে গ্রন্থ রচনার কথা প্রত্যেক বাঙ্গালীর জানা উচিত'

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: রবি, ১৩/০৯/২০২০ - ১২:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক, পতিসরে জমিদারির কাজ দেখতে এসেছেন বাবুমশাই। সেখানে আমিনের সেরেস্তায় কাজ করেন এক ঋজুদেহী ব্রাহ্মণ। তাঁর ডাক পড়ল বাবুমশাইয়ের কাছে। বাবুমশাই বললেন, ‘‘দিনে তো সেরেস্তায় কাজ করো, রাত্রিতে কী করো?’’

‘‘সন্ধ্যার পর কিছুক্ষণ সংস্কৃতের আলোচনা করি। কিছুক্ষণ একখানি বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে প্রেসের কপি-পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি।’’

পাণ্ডুলিপি!
শুনে বাবুমশাই যেন চমকে উঠলেন। দেখতে চাইলেন সেই পাণ্ডুলিপি। দেখলেন। কোনও কথা না বলে ফেরতও দিলেন।
দিন কয়েক পরের ঘটনা।
আচমকা শান্তিনিকেতন থেকে একটি বার্তা এল পতিসরের ম্যানেজার শৈলেশচন্দ্র মজুমদারের কাছে।

তাতে লেখা, ‘‘শৈলেশ, তোমার সংস্কৃতজ্ঞ কর্মচারীকে এইখানে পাঠাইয়া দাও।’’
এই বাবুমশাইটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর কর্মচারী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

হ্যাঁ, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচয়িতা সেই হরিচরণ।

বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায় এবং অবশ্যই ঠাকুর পরিবারের দিকপালদের সঙ্গে একই সারিতে রবীন্দ্রনাথ হরিচরণকে ঠাঁই দিয়েছিলেন অধ্যাপক হিসেবে।

হরিচরণ। জন্ম ২৩ জুন ১৮৬৭। বাবা নিবারণচন্দ্র। মা জগৎমোহিনী দেবী। ছেলেবেলা কেটেছে মামার বাড়িতে। তারপর মায়ের হাত ধরে চব্বিশ পরগনার যশাইকাটি। আর্থিক সাচ্ছন্দ্য যে কী বস্তু, তা কোনও কালে টের পাননি হরিচরণ। প্রাথমিক পড়াশোনা যশাইকাটিতেই। এর পর কলকাতার জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন, মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন...। স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই। বেতন দেওয়ার টাকা নেই। এই ছিল হরিচরণের ইস্কুলবেলা। আর সেখানেও জড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-স্মৃতি।

মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে বেতন তখন তিন টাকা। কিশোর হরিচরণ পড়ল মহা ফাঁপরে। কোথা থেকে টাকা জোগাড় হবে! এক বন্ধু জানাল পটলডাঙার মল্লিকবাবুরা কয়েক জন ছাত্রের বেতন দেন। শোনামাত্র দরখাস্ত করে দিল স্কুলের সভাপতিকে। সেই পদে তখন ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এর সম্পাদক জাঁদরেল নরেন্দ্রনাথ সেন। দরখাস্তের সঙ্গে দু’টি সুপারিশ পত্রও জুড়ে দিল হরিচরণ।

প্রথমটি সেকালের বিখ্যাত চিকিৎসক চন্দ্রমোহন ঘোষের। তাঁর সুপারিশ দেখামাত্র ‘আমি ইহাকে চিনি না’ বলে পাত্তাই দিলেন না নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর চোখ বিস্ফারিত দ্বিতীয় সুপারিশপত্রটি পেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! এর পর দরখাস্তকারীকে আর কী করে অবজ্ঞা করেন?

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিচরণের যোগসূত্রটা অবশ্য বাঁধা হয়েছিল অন্য একটি সূত্রে। তাঁর মূলে ছিলেন যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর বেশ যোগাযোগ। হরিচরণের বয়েস তখন পনেরো কী ষোলো। যদুনাথ খবর আনলেন বাবুদের বাড়িতে নাটক হবে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। অভিনয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

শুনে আর যেন স্থির থাকতে পারল না কিশোর হরিচরণ। এ পালা তাকে দেখতেই হবে। দেখেওছিলেন শেষ পর্যন্ত। বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত হরিচরণের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে বেঁচে ছিল দস্যুবেশী রবীন্দ্রনাথের সেই ছবিটা। বেশ লেগেছিল দস্যু সর্দারের চরিত্রে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর অভিনয়ও।
বয়েস যত বেড়েছে কবি-সান্নিধ্য প্রবল হয়েছে হরিচরণের! দাদা যদুনাথ এটা টের পেয়েছিলেন। পতিসরের চাকরিটা জোটে মূলত এই যদুনাথেরই উদ্যোগে।

শান্তিনিকেতনে তখন প্রায় বছর তিনেক শিক্ষকতা করা হয়ে গিয়েছে হরিচরণের। এমন সময় এক দিন রবীন্দ্রনাথ হরিচরণের কাছে একটা ইচ্ছা প্রকাশ করে বসলেন।

কী রকম?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘আমাদের বাংলা ভাষায় কোনও অভিধান নেই, তোমাকে একখানি অভিধান লিখতে হবে।’’

গুরুদেবের নির্দেশ। অমান্য করবেন কোন সাহসে! বরং প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হরিচরণ। দিনরাত এক করে চলল শব্দ আর তার অর্থের সন্ধান। তাঁর উদ্যোগ দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিপাঠীকে লিখলেন, ‘‘এ গ্রন্থখানি রচিত ও প্রকাশিত হইলে দেশের একটি মহৎ অভাব দূর হইবে।’’ মাঝে একবার শুধু ছেদ পড়ল কাজে। খুব আর্থিক অনটন সে বার শান্তিনিকেতনে। বাধ্য হয়েই কাজ ছাড়লেন হরিচরণ।
সেন্ট্রাল কলেজের ক্ষুদিরাম বসুর সাহায্যে মিলল অন্য একটা চাকরি। ওই কলেজেই সংস্কৃত পড়ানোর।

পড়াতে লাগলেন ঠিকই। কিন্তু মন তাঁর পড়ে থাকে আশ্রমে! এ দিকে আবার অভিধানের কাজটিও এগোচ্ছে না— সব মিলিয়ে প্রচণ্ড মানসিক পীড়ায় ভুগতে লাগলেন হরিচরণ। ফের দরবার রবীন্দ্রনাথের কাছে। গেলেন জোড়াসাঁকোয়। সবটা শুনলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়ে গেলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাছে। আশা, যদি কিছু একটা হিল্লে হয়।

মহারাজা মাসিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি দিলেন হরিচরণকে। সেটা হরিচরণ পেয়েছিলেন প্রায় আট বছর। পরের চার বছরে মিলেছিল ষাট টাকা করে বৃত্তি। আবেগে আপ্লুত হরিচরণ কাঁদতে কাঁদতে পা জড়িয়ে ধরেছিলেন গুরুদেবের।রবীন্দ্রনাথের ছিল মৃদু প্রতিক্রিয়া— ‘‘স্থির হও, আমার কর্তব্যই করেছি।’’
বৃত্তি পেয়ে সেই যে কলকাতার পাততাড়ি গুটোলেন হরিচরণ, আর কোনও দিন অন্য দিকে ফিরেও চাননি।

১৯৫৯ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনেরই বাসিন্দা। প্রায় দু’দশকের চেষ্টায় পাণ্ডুলিপি খানিক তৈরি করে ফেললেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে বিশ্বভারতী থেকেই প্রকাশ হোক এই মহাগ্রন্থটির। গুরুদেব দায়িত্ব দিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে।
কিন্তু ছাপার টাকা কোথায়?

বিশ্বভারতীর কোষাগারে তখন বেহাল অবস্থা। দীনেশচন্দ্র সেন ও সুনীতিকুমার গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদি ছাপা যায়!
কিন্তু রেজিস্ট্রার জানিয়ে দিলেন ছাপার জন্য লাগবে হাজার পঞ্চাশেক টাকা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট-সদস্য। যোগাযোগ করা হল তাঁর সঙ্গে। কোনও আশা দিতে পারলেন না তিনিও। ভীষণ দুশ্চিন্তায় তখন গোটা শান্তিনিকেতন। মাঝেসাঝেই আলোচনায় বসছেন রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ ও সুনীতিকুমার। কিন্তু সমাধানের রাস্তা মেলে কই!

হরিচরণ কিন্তু নাছোড়। গুরুদেবের কথামতো তৈরি করা অভিধানকে প্রকাশের আলো যে দেখাতেই হবে। গেলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কোষাধ্যক্ষ অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের কাছে। পরিষদের কোষাগারও তখন বেহাল। তাই অমূল্যবাবুও ফিরিয়ে দিলেন। টানা প্রায় দশটা বছর পাণ্ডুলিপি পড়ে রইল। ছাপার মুখ দেখল না। প্রকাশের সন্ধানে প্রাণপাত করার পাশাপাশি হরিচরণ তখন আরও একটি কাজ করলেন। দ্বিতীয়বার পুরো অভিধানটি সংশোধন সেরে ফেললেন।

বহু কষ্টে অবশেষে প্রকাশক জুটল। ‘বিশ্বকোষ’-এর নগেন্দ্রনাথ বসু। তিনি জানালেন, প্রকাশ করবেন। তবে কাগজের দামটা এখনই দিতে হবে। ছাপার খরচটা পরে দিলেও চলবে। এই শর্তেই হরিচরণ রাজি। নিজের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে দিলেন বই প্রকাশের কাজে। তারপর একে একে তেরো বছর ধরে প্রকাশিত হল মোট একশো পাঁচটি খণ্ড।

বিশ্বভারতী কোনও কমিশন ছাড়াই অভিধান বিক্রির ব্যবস্থা করল। অর্থ সাহায্য করলেন রথীন ঠাকুর, নাড়াজোলার মহারাজা, আশ্রমিক সঙ্ঘ, বিশ্বভারতী সংসদ কর্তৃপক্ষ। পত্র-পত্রিকাগুলি তখন ধন্য ধন্য করছে হরিচরণের। এক সময় মহাত্মা গাঁধীর কাছ থেকেও প্রশংসা এল। মহাত্মা তাঁর হরিজন পত্রিকায় হরিচরণকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলবার্ট মারের সঙ্গে তুলনা করলেন।

হরিচরণের মৃত্যুর পর ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে দু’খণ্ডে গোটা অভিধানটি প্রকাশ করে সাহিত্য অ্যাকাডেমি।

এই অভিধানটি তৈরির সময় হরিচরণের শ্রম-নিষ্ঠার কাহিনি যে কী বিচিত্র! সুরঞ্জন ঘোষ একটি লেখায় বর্ণনা দিয়েছেন যেমন— ‘‘প্রতিদিন সান্ধ্য আহ্নিক সেরে লন্ঠনের আলোয় কুয়োর ধারে খড়ের চালাঘরে পশ্চিম জানলার কাছে হরিবাবু কাজ করতেন। সুনীতিকুমারের স্মৃতিতেও এই ‘ক্ষীণপ্রায় ব্রাহ্মণ’-এর ছবিটা প্রায় একই রকম। সুনীতিবাবু যখনই হরিচরণের বাড়ি যেতেন, তখনই দেখতেন তক্তপোষের উপর ডাঁই করে রাখা উর্দু, পার্সি, ইংরেজি, ওড়িয়া, মারাঠি-সহ বিভিন্ন ভাষার অভিধান ছড়ানো রয়েছে। দ্বিজেন ঠাকুর তো ছড়াই বেধে ফেলেছিলেন, ‘‘কোথা গো মেরে রয়েছ তলে/ হরিচরণ, কোন গরতে?/ বুঝেছি, শব্‌দ-অবধি-জলে/ মুঠাচ্ছ খুব অরথে।।’’

গুরু-দক্ষিণা হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অর্পণ করেছিলেন তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। আর দু’টি চোখ। এক সময় দৃষ্টিশক্তি চলে যায় তাঁর। হরিচরণের তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিল না। বরং তাঁকে বলতে শোনা যেত, ‘‘গুরুদেবের নির্দিষ্ট কাজে চোখ দু’টো উৎসর্গ করতে পেরেছি, এটাই পরম সান্ত্বনা।’’
নিয়মনিষ্ঠা শুধু অভিধান রচনাতেই নয়, রোজের জীবনেও।সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাঁটতে যেতেন। তারও একটা সীমানির্দেশ ছিল—তালগাছ পর্যন্ত। তার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত যেন নিয়মের বেড়িতে বাঁধা। হেঁটে ফিরে জলখাবার। জলখাবারের তালিকাটিও ভীষণ সাদামাঠা। মুড়ি, দুধ আর সামান্য কিছু ফল। তারপর লাইব্রেরিতে পড়াশোনা। ফিরে এসে দুপুরের খাওয়া। নিরামিষ। পাতে একটা জিনিস থাকা চাই-ই— তেঁতুলের জল। এতে নাকি দেহে ‘তাপ কম লাগে’।দুপুরের খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। সেই সময় তাঁকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানো হত। রাতের খাওয়া আটটার মধ্যে শেষ।
বিলাসিতা ছিল একটাই। খাবার শেষে এক খিলি পান না হলে চলত না।

প্রতিদিন আহ্নিকের পরে ‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’র কয়েকটি অধ্যায় পড়া ছিল তাঁর অভ্যাস। বৃদ্ধ বয়সে যখন চোখের দৃষ্টি প্রায় চলে গিয়েছে, তখনও এই অভ্যাসটিতে ছেদ পড়েনি। তখন শুধুমাত্র স্মৃতির উপর নির্ভর করে আওড়ে যেতেন গীতার একের পর এক অধ্যায়। রোজের রুটিনে কোনও বাধা না-পসন্দ হরিচরণের। দুনিয়া উল্টে গেলেও নিয়মমাফিক কাজ থেকে উঠিয়ে তাঁকে অন্য খানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না কারও।
আরও একবার। বুধবার। উপাসনার সময়। রবীন্দ্রনাথ চেয়ে দেখলেন উপাসনায় যোগ দেননি অধ্যাপকদের একাংশ। নেই হরিচরণও।
খুব রেগে গেলেন কবি। তিরস্কার করে জানতে চাইলেন, কেন যোগ দেননি উপাসনায়?

শান্ত স্বরে হরিচরণের উত্তর, ‘‘এটা আমার সান্ধ্যকৃত্যের সময়, তাই উপস্থিত হতে পারিনি।’’ এর পর আর রবীন্দ্রনাথ রাগ করে থাকতে পারেননি। বরং পরে হরিচরণকে বলেন, ‘‘তোমাকে অপ্রিয় কথা বলেছি, তুমি কিছু মনে কোরো না, ভাববে এটা আমার চিত্তদৌর্বল্য।’’হরিচরণের কথা বললেই এক প্রাচীন আশ্রমিক শান্তিনিকেতনের ছবিটাও যেন ফিরে দেখা যায়।

১৯৫৬ সালের গরমে একবার ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী দেখা দিল শান্তিনিকেতনে। সবকিছু লন্ডভন্ড। গুরুপল্লিতে হরিচরণের ছোট্ট বাড়িটাও গেল নষ্ট হয়ে। বৃদ্ধ হরিচরণকে দেখা গেল এক চৌকিতে বসে করুণ গলায় শুধু আর্তনাদ করে চলেছেন ‘‘আমার বইগুলো বাঁচাও।’’
আশ্রমের সকলে মিলে রক্ষা করেছিলেন তাঁদের প্রিয় হরিবাবুর সম্পত্তি— তাঁর প্রাণপ্রিয় ‘বইগুলো’।
লেখার সুত্র - ‘হরিচরণ’ (কোরক সংকলন), ‘শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ (সুশীল রায়)

প্রায় ৫০০০ পাতার এই একমেবাদ্বিতীয়ম এই দুই খণ্ডের অতিমূল্যবান বঙ্গীয় শব্দকোষ সেই দূরের কোলকাতা থেকে বয়ে নিয়ে এসেছেন প্রিয় মোশাররফ ভাই, এগুলো এখন রাজশাহীর লাইব্রেরীতে ঠাই পেয়েছে, মোশাররফ ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই।

বইটার পিছনের ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের তথ্য দিয়েছিলেন লেখক-গবেষক বাবলু ভট্টাচার্য, তাঁর ভাষায় ‘হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু "একটি জীবন" নামে অসাধারণ একটি ছোট গল্প লিখেছেন। সত্যজিৎ রায় সেই গল্পের চলচ্চিত্রায়ন করার জন্যে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। কিন্তু কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে বিভিন্ন বয়সের অভিনয় করার বয়স ছিল না তখন, তাই রায়বাবু ছবিটি করেন নি।পরবর্তীতে রাজা মিত্র সত্যজিৎ রায়ের সাথে সরাসরি দেখা করে "একটি জীবন" ছবিটি করার অনুমতি নিয়ে কাজ শেষ করেন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর চরিত্রে সৌমিত্রের অভিনয় মুগ্ধ করে।“

অপেক্ষা করছি সিনেমাটি দেখার। এবং এই লেখার মাধ্যমে আরেকবার কৃতজ্ঞতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত হরিচরণের ওপর একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন অনেক আগে, কিছুদিন আগে পড়ে খানিক প্রচার করেছিলাম, প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে যোগ করে গেলাম।

পণ্ডিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৬৭ - ১৯৫৯

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথম যুগে যারা রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিদ্যালয়ের কাজে এসে যােগ দিয়েছিলেন তারা সকলেই অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন এমন কথা কেউ বলবে না। দু-একজন অবশ্যই অসাধারণ ছিলেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু অন্যান্যদের বেলায় এ কথা নির্বিবাদে বলা যেতে পারে যে বিদ্যায় বুদ্ধিতে তাদের সমকক্ষ ব্যক্তির অভাব দেশে তখনও ছিল না, এখনও নেই। অথচ নিজ নিজ ক্ষেত্রে এরাও অনেকেই অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এরা স্বেচ্ছায় এমন-সব কার্যভার স্বহস্তে গ্রহণ করেছিলেন, আজকের সাংসারিক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা যাকে হঠকারিতা বলে মনে করবেন। মনে হবে আপন সাধ্যসীমা ভুলে গিয়ে তারা সাধ্যাতীতের স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকল অবিশ্বাসীর অবিশ্বাসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আপন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন। বাস্তবিক পক্ষে তারা যে ভাবে কাজ করেছেন তাকে একমাত্র সাধনা নামেই অভিহিত করা যায়, মাস-মাহিনার চাকুরে দ্বারা এ জাতীয় কাজ কখনােই সম্ভব নয়। যে কাজে বহুজনের মিলিত প্রয়াস প্রয়ােজন কখনাে কখনাে সম্পূর্ণ একক চেষ্টায় সে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কর্তা অকিঞ্চন, কীর্তি সুমহান। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে কর্তার তুলনায় কীর্তি বহুগুণে বৃহৎ। বস্তুতঃ তা নয়, কীর্তি কখনাে কর্তাকে ছাড়িয়ে যায় না। বাহ্যতঃ যা দৃষ্টিগােচর ছিল না সেই শক্তি তাদের চরিত্রের মধ্যে নিহিত ছিল। সুবৃহৎ কার্যে সব চেয়ে বেশি প্রয়ােজন নিষ্ঠা এবং অভিনিবেশ। বিদ্যাবুদ্ধি তাে ছিলই, তদুপরি উক্ত দুই গুণসন্নিপাতে সাধারণ মানুষের দ্বারাও অসাধারণ কার্য সম্পাদন সম্ভব হয়েছিল।

এর কৃতিত্ব অনেকাংশে শান্তিনিকেতনের প্রাপ্য, কারণ এরূপ মানুষ শান্তিনিকেতন নিজ হাতে তৈরি করেছে। আমাদের দেশে স্থানমাহাত্ম্য বলে একটা কথা আছে ; সেটা কেবলমাত্র স্থান-বিশেষের মাটি জল-হাওয়ার গুণ নয়। সে স্থানই মহৎ যে স্থান মানুষের কাছ থেকে বড় কিছু দাবি করতে জানে। দাবি করবার অধিকার সব স্থানের থাকে না। সে অধিকার অর্জন করতে হয় অর্জন করতে হয় নিজের দান-শক্তির দ্বারা। যে দিতে জানে সেই দাবি করতে জানে। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে শান্তিনিকেতনের দান অপরিসীম। শান্তিনিকেতনই দেশকে প্রথম শিখিয়েছে যে বিদ্যালয় কেবলমাত্র বিদ্যাদানের স্থান নয়, বিদ্যাচর্চার স্থান; শুধু বিদ্যাচর্চা নয়, বিদ্যা-বিকিরণের স্থান। বিদ্যার্জনের পথ সুগম করে দেওয়া বিদ্যাকেন্দ্রের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। যে সময়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহও এসব কথা ভাবে নি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় তার শৈশবেই সেসব কথা ভেবেছে এবং সেজন্যে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। শান্তিনিকেতনের স্থানমাহাত্ম্য বলতে এই অর্থেই বলেছি। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজের সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছিলেন শান্তিনিকেতনের সেবায়। সেই জোরে তিনি যাদের আহ্বান করেছিলেন তাদের কাছ থেকে নিঃসংকোচে সর্বশক্তি নিয়ােগের দাবি করতে পেরেছিলেন।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মশায় যখন রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে বঙ্গীয় শব্দকোষ রচনায় প্রবৃত্ত হন তখন বঙ্গীয় পণ্ডিত সমাজে তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন। বয়সে নবীন, অভিজ্ঞতায় অপ্রবীণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপটুকু পর্যন্ত নেই, প্রামাণিক কোনো গ্রন্থ রচনা করে পাণ্ডিত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন নি। এরূপ সুবৃহৎ কাজের জন্যে তার প্রস্তুতি কতখানি সে বিষয়ে সাধারণের মনে সংশয় থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না ; থাকলে এমন নিশ্চিন্ত মনে এই বিশাল কার্যভার তার উপরে ন্যস্ত করতে পারতেন না। এই সম্পর্কে একটি কথা অনেক সময়ে আমার মনে হয়েছে। শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগে রবীন্দ্রনাথের অধ্যাপক-নির্বাচন অনেকটা যেন শেক্সপীয়ারের প্লট-নির্বাচনের মতাে। হাতের কাছে যেমন-তেমন একটা গল্প পেলেই হল, শেক্সপীয়ার চোখ বুজে তাকেই গ্রহণ করেছেন। প্রতিভাবানের হাতে ছাই ধরলেও সোনা হয়ে যায়। অত্যন্ত শীর্ণ বিবর্ণ কাহিনীও রক্তমাংস-অস্থিমজ্জার সংযোগে পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে, রঙে রসে পূর্ণতা লাভ করেছে, নিষ্প্রাণ কাহিনী প্রাণের স্পন্দনে অপুর্ব বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। পণ্ডিত সমালােচকদের মতে মূল কাহিনীতে শেক্সপীরীয় ঐশ্বর্যের আভাসমাত্র ছিল না। অবশ্য এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে একমাত্র শেক্সপীয়ারের কবিদৃষ্টিতেই সেইসব শীর্ণ কাহিনীর অনুচ্চারিত সম্ভাবনাটুকু ধরা পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও এ কথা প্রযােজ্য। আপাতদৃষ্টিতে যে মানুষ সাধারণ তারও প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথের সর্বদর্শী দৃষ্টিকে এড়াতে পারে নি। জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারীকে অধ্যাপনার কাজে ডেকে এনে একজনকে দিয়ে লিখিয়েছেন ছেলেমেয়েদের উপযােগী করে বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞান-গ্রন্থমালা, আরেকজনকে দিয়ে বাংলা ভাষার বৃহত্তম অভিধান। বিধুশেখর শাস্ত্রী ইংরেজি ভাষায় অনভিজ্ঞ টোলের পণ্ডিত, সেই মানুষ কালক্রমে বহুভাষাবিদ পণ্ডিতে পরিণত হলেন ভারতীয় পণ্ডিতসমাজে সর্বাগ্রগণ্যদের অন্যতম। ক্ষিতিমােহন সেনও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, তারও জিজ্ঞাসা নতুন পথে প্রবাহিত হল- মধ্যযুগীয় সাধুসন্তদের বাণী সংগ্রহ করে ভারতীয় জীবনসাধনার বিস্মৃতপ্রায় এক অধ্যায়কে পুনরুজ্জীবিত করলেন। এ সমস্তই সম্ভব হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায়। তিনি দাবি করেছেন, এরা প্রাণপণে সেই দাবি পূরণ করেছেন। দাবি পূরণ করতে গিয়ে এঁদের শক্তি দিনে দিনে বিকাশ লাভ করেছে। ক্ষিতিমােহনবাবু বলতেন, জান, আমরা ছিলাম সব মাটির তাল, গুরুদেব নিজ হাতে আমাদের গড়ে নিয়েছেন, নইলে যে বিদ্যা শিখে এসেছিলাম তাও ঠিক মতো ব্যবহার করা আমাদের সাধ্যে কুলাতো না।

রবীন্দ্রনাথ যে চোখ বুজে এঁদের গ্রহণ করেছিলেন এমন নয়, চোখ মেলেই করেছিলেন। মানুষ যাচাই করবার বিশেষ একটি রীতি তার ছিল। প্রথমেই দেখে নিতেন দৈনন্দিনের দাবি মিটিয়ে মানুষটির মধ্যে উদ্বৃত্ত কিছু আছে কি না। রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের সাধনা উদ্বৃত্তের সাধনা। সংসারের পনেরো আনা মানুষই আটপৌরে, তাদের দিয়ে নিত্য দিনের গৃহস্থালির কাজটুকু শুধু চলে, বাড়তি কিছু দেবার মত সম্বল এদের নেই। জমিদারি মহল্লা পরিদর্শন করতে গিয়ে আমিনের সেরেস্তায় নিযুক্ত হরিচরণকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দিনে সেরেস্তার কাজ কর, রাত্রিতে কি কর ? হরিচরণ বলেছিলেন, সন্ধ্যাবেলায় তিনি একটু সংস্কৃতের চর্চা করেন, একখানা বইএর পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত আছে। পাণ্ডুলিপিটি চেয়ে নিয়ে দেখে নিলেন। মানুষ কিভাবে অবসর যাপন করে তাই দিয়ে তার প্রকৃত পরিচয়। যার মধ্যে উদ্বৃত্ত কিছু নেই তার অবসর কাটে না। ঐ সামান্য বাক্যালাপ থেকেই হরিচরণবাবুর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাটি কবি দেখতে পেয়েছিলেন। এই কারণেই অত্যল্পকাল মধ্যে ম্যানেজারের নিকট নির্দেশ এল, তোমার সংস্কৃতজ্ঞ কর্মচারীটিকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দাও। কবি তখন বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে ‘সংস্কৃত প্রবেশ’ নামে একটি পুস্তক রচনায় নিযুক্ত ছিলেন। সংস্কৃত শিক্ষার সহজ প্রণালী উদ্ভাবনই ঐ পুস্তকের উদ্দেশ্য ছিল। হরিচরণবাবু আসবার পরে কবি তার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটি হরিচরণবাবুর হস্তে অর্পণ করেন। অধ্যাপনা-কার্যের অবসরে তিনি কবির নির্দেশ মত ঐ পুস্তকরচনা সমাপ্ত করেন।

১৩০৯ সালে অর্থাৎ বিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠার বৎসরকাল মধ্যেই হরিচরণবাবু শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কর্ম নিষ্ঠার দ্বারা অল্পকাল মধ্যেই নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন, নতুবা কাজে যোগ দেবার পর দু বৎসর অতিক্রান্ত হতে না হতেই ৩৭/৩৮ বৎসরের এক যুবককে ঐ সুবৃহৎ অভিধান রচনার কার্যে আহ্বান করতেন না। অপরপক্ষে শান্তিনিকেতনে বসবাসের শুরু থেকেই বিদ্যাচর্চায় যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা তিনি বোধ করেছেন সে কথা আত্মপরিচয়-প্রসঙ্গে হরিচরণবাবু নিজ মুখেই ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব তাঁর কাছে দেবতার আশীর্বাদের মতো মনে হয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ নম্রহৃদয়ে নতমস্তকে কবির আদেশ শিরোধার্য করে নিলেন। ১৩১২ সালে অভিধান রচনার সূচনা, রচনাকার্য সমাপ্ত হল ১৩৩০ সালে। মাঝে আর্থিক অনটনের দরুণ শান্তিনিকেতনের কর্ম ত্যাগ করে তাকে কিছু কালের জন্য কলকাতায় যেতে হয় এবং অভিধান-সংকলনের কাজ বন্ধ থাকে। এটি তার নিজের পক্ষে যেমন রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও তেমনি ক্লেশের কারণ হয়েছিল। তাকে অবিলম্বে শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে আনবার জন্যে কবি নিজেই উদ্যোগী হলেন। রবীন্দ্রনাথের আবেদনক্রমে বিদ্যোৎসাহী মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী অভিধান-রচনাকার্যে সহায়তার উদ্দেশ্যে হরিচরণবাবুর জন্য মাসিক পঞ্চাশ টাকার একটি বৃত্তি ধার্য করেন। ১৩১৮ সাল থেকে অভিধান-সংকলনকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত তেরো বৎসর কাল তিনি এই বৃত্তি ভোগ করেছেন। বাংলা দেশের গৌরবের কথা যে, ইংরেজি ভাষার প্রথম অভিধান রচয়িতা ডক্টর জনসন যে সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন হরিচরণবাবুর বেলায় তা ঘটে নি। মহারাজের মহানুভবতার কথা শেষ পর্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন ; আর রবীন্দ্রনাথ যে তার জন্যেই উপযাচক হয়ে মহারাজের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন সে কথাও মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হন নি। মুদ্রণকার্য শুরু হবার পূর্বেই মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্রের মৃত্যু হয়। যার সহায়তায় অভিধান রচনা সম্ভব হল তাকে স্বহস্তে একখণ্ড অভিধান কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্যস্বরূপ অর্পণ করতে পারেন নি, এই দুঃখ শেষ পর্যন্ত তার ছিল। ১০৫ খণ্ডে সমাপ্ত অভিধান-মুদ্রণ শেষ হবার পূর্বে রবীন্দ্রনাথও বিদায় নিলেন। হরিচরণবাবুর করুণ উক্তি-- যিনি প্রেরণাদাতা, যার অভীষ্ট এই গ্রন্থ তিনি স্বৰ্গত, তাঁর হাতে এর শেষ খণ্ড অর্পণ করতে পারি নি। কিন্তু হরিচরণবাবু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয় নি। বলেছিলেন, মহারাজের বৃত্তিলাভ বিধাতার অভিপ্রেত, অভিধান সমাপ্ত হবার পূর্বে তােমার জীবনান্ত হবার আশঙ্কা নাই। কবিবাক্য মিথ্যা হয় না, এ ক্ষেত্রেও হয় নি।

পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ হয় ১৩৩৩ সনে। তার পরেও প্রায় দশ বৎসর কাল অপেক্ষা করতে হয়েছে অর্থাভাবে মুদ্রণকার্যে হাত দেওয়া সম্ভব হয় নি। এরূপ বিরাট গ্রন্থ প্রকাশের সামর্থ্য বিশ্বভারতীর ছিল না। অবশ্য মাঝে এই কয়েক বৎসরও তিনি অভিধানের নানা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। অবশেষে ১৩৩৯ সালে মুদ্রণকার্য শুরু হয়। তিনি নিজেই তার যৎকিঞ্চিৎ সম্বল নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ক্রমশঃ প্রকাশের আয়োজন করেন। প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় তারা পূর্ববৎ নিজ আসনে নিজ কাজে অভিনিবিষ্ট থাকতেন। কাজের সঙ্গে মাস-মাহিনার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

অভিধান-মুদ্রণ শেষ হবার পরেও তাকে নিত্য দেখেছি। প্রাতঃভ্রমণ এবং সান্ধ্যভ্রমণ নিত্যকর্ম ছিল। ক্ষীণদৃষ্টিবশতঃ পথে দেখা হলে সব সময় লোকজন চিনতে পারতেন না। কখনো চিনতে পারলে সস্নেহে কুশলবার্তা জিজ্ঞেস করতেন। বিরানব্বই বৎসর বয়সে ১৯৫৯ সালে তিনি দেহরক্ষা করেছেন। শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কের শক্তি অটুট ছিল। শেষবয়সে তাকে দেখলে একটি কথা প্রায়ই মনে হত। ইংরেজ ঐতিহাসিক তথা সাহিত্যিক গিবন তাঁর Decline and Fall of the Roman Empire রচনা সমাপ্ত করে বলেছিলেন, হঠাৎ মনে হল জীবনের সব কাজ ফুরিয়ে গিয়েছে, কিছুই আর করবার নেই। মনে খুব একটা অবসাদের ভাব এসেছিল। গিবন উক্ত গ্রন্থ প্রণয়নে দীর্ঘ বারো বৎসর কাল একান্ত মনে নিযুক্ত ছিলেন, আর হরিচরণবাবু জীবনের চল্লিশ বৎসর কাল অনন্যমনা হয়ে এক কাজে মগ্ন ছিলেন। কর্মাবসানে তার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল জানতে কৌতুহল হত। গ্রন্থ সমাপ্তির পরেও চৌদ্দ বৎসর তিনি জীবিত ছিলেন। যখনই দেখেছি তাকে প্রসন্নচিত্ত বলেই মনে হত। এরূপ সাধক মানুষের মনে কোথাও একটি প্রশান্তি বিরাজ করে। এজন্য সুখে-দুঃখে কখনো তারা বিচলিত হন না।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ইংরেজ ঐতিহাসিক তথা সাহিত্যিক গিবন তাঁর Decline and Fall of the Roman Empire রচনা সমাপ্ত করে বলেছিলেন, হঠাৎ মনে হল জীবনের সব কাজ ফুরিয়ে গিয়েছে, কিছুই আর করবার নেই।

খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন হবে এই অনুভূতিটা। কাজ সম্পূর্ণ করার পরিতৃপ্তি আর সেই সঙ্গে কাজটা শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্টটা। কোনটা বেশি তীব্র হয়ে ওঠে এই সময়। সার্থকতার উল্লাসের চেয়েও কি সব হারিয়ে ফেলার হাহাকারটাই বড় হয়ে ওঠেনা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তারেক অণু এর ছবি

বাহ, আগে পড়া ছিল না। ধন্যবাদ ভাই

সোহেল ইমাম এর ছবি

এগুলো এখন রাজশাহীর লাইব্রেরীতে ঠাই পেয়েছে

ভাই কোন লাইব্রেরিতে আছে? মিয়াপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি না মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সরকারি পাবলিক লাইব্রেরি?

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তারেক অণু এর ছবি

আমাদের বাড়ির লাইব্রেরীটা ভাই, শিরোইলে। এবং সেটা আপনারও লাইব্রেরী, যখন ইচ্ছে চলে আসবেন

সুমন চৌধুরী এর ছবি
তারেক অণু এর ছবি

এবং এখনো বইয়ের কলেবর অনুযায়ী দাম বেশ কমই দেখলাম।

করবী মালাকার এর ছবি

লেখাটি পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।

তারেক অণু এর ছবি

শুভেচ্ছা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।