কোথায় পাবো তারে... ১

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: শনি, ১৯/১২/২০২০ - ১০:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইলো
কাননে কুসুম কলি সকলই ফুটিলো...”

অন্ধকারের গর্ভ থেকে ভোরের উদ্ভাসন । মানবের জন্ম মুহূর্তেও কি থাকে এমন কোন উন্মেষ ? কী সেই উন্মেষ ?

অর্ধশত বছর আগে এক শীতের ভোরে জন্ম । পৃথিবীর নিয়মে পেরিয়ে গেছে সময় । শীতের রাতে হ্যাজাক বাতির আলোয় কবিয়াল গানের আসরে মা’র কোলে লেপ্টে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি ক্রমশঃ বড় হয়েছে। ধু-ধু শৈশবে পৌষ মাসে গ্রামে বসতো মেলা । গফুর সাধুর মাজার ঘিরে বসা সেই মেলাই ছিল গ্রামের একমাত্র মিলনমেলা । ধানকাটা মাঠে শামিয়ানার নিচে বসতো কবিয়াল গানের আসর । সেই আসরে রাতভর চলতো মরমী গান । কখনও কৃষ্ণ প্রেমে আকুল রাধিকা গাইতো, “হাড় কালা করলামরে আমার দেহ কালার লাইগা...” । কখনও কোন বাউল গেয়ে উঠতো, “আমি আমারে দিয়া তোমারে, আমি তোমার কে হই গো দয়াল ?...” । বাউলের মুদিত দুই চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়তো নোনা জল । তার সেই করুন সুর মেলার মাঠ পেরিয়ে পৌঁছে যেত উর্ধ্বলোকে...

।। এক ।।

বরাবরের মা নেওটা সন্তান । শরীর, মনের সর্বশক্তি দিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে থাকা এক অবোধ সন্তান । কে জানে কোন সে হারানোর ভয়ে ? জীবনের সঙ্গে ট্রেন জার্নির বেশ মিল । স্টেশন থেকে স্টেশনে ছুটছে ট্রেন, কেউ উঠছে কেউ নামছে । কেউ কাছে আসছে, কেউ যাচ্ছে দূরে । জীবনভর সেই জার্নিতে শুধুই হারিয়ে যাওয়ার ভয়, হারিয়ে ফেলার ভয়...

তখন প্রাথমিকের নিচের দিকের ক্লাস । একবার আব্বার সঙ্গে কাঁচাবাজারে গিয়েছিলাম । তখনকার দিনে গেরস্থালী বাজারকে বলা হত কাঁচাবাজার, খুব পরিচ্ছন্য ছিল না সেই বাজার । মাছের ভেজা পানি, খাঁচার মধ্যে মুরগী, পাকা ফলের ওপর ভোঁ-ভোঁ মাছিদের সঙ্গে দেখা মিলত । আব্বা আমাকে একটা আপাতঃ পরিচ্ছন্য জায়গার দাঁড় করিয়ে রেখে গেলেন বাজারের কর্দমাক্ত অংশ থেকে মুরগী কিনতে । দাঁড়িয়ে আছি আমি । সময়ের কোন ধারণা তৈরী হয়নি । এক মিনিট...পাঁচ মিনিট...বড়জোর দশ মিনিট । কিন্তু মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছি । আর হচ্ছিল ভয়াবহ ভয় । হারিয়ে যাওয়ার ভয় । আব্বা ফিরে আসতেই ছোট্ট দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম, “আব্বা, এত দেরী করছেন ! আমি ভেবেছি, আমি হারিয়ে গেছি ।” সেদিন আব্বা চোখ মুছিয়ে কী বলেছিলেন, আজ আর মনে নেই । তবে বাড়ি এসে মা’র কাছে বকা খেয়েছিলেন খুব - তা মনে আছে । মা কখনও এক মুহুর্তের জন্য হাত ছাড়তেন না । মা’র হাতের মুঠোয় কী যে নির্ভরতা !

।। দুই ।।

তখনও স্কুল শুরু হয়নি । সব ভাই-বোনেরা গ্রামের স্কুলের পাট চুকিয়ে ঢাকায় বড় আপার কাছে চলে গেছে । কেউ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, কেউ বুয়েট আর কেউ কলেজে পড়ছে । বাড়িতে শুধু মা আর আমি । হঠাৎ করেই মা’র খুব জ্বর হল । খবর পেয়ে বড় আপা ভাই-বোনদের নিয়ে বাড়িতে এল । শীতকাল । মা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে চাচী-জেঠিদের নিয়ে পিঠা-পুলি করলেন । বাড়িতে উৎসব লেগে গেল ।

সবাই চলে যাওয়ার ক’দিন পরের এক দুপুর । উঠানে খেত থেকে তোলা মরিচের স্তুপ । দুর্বল শরীরে মা সেসবের বন্দোবস্ত করছেন । অপ্রত্যাশিতভাবে ছোটভাই ঢাকা থেকে এল । মা কেন যেন খুশি না হয়ে বলে উঠল, “কি রে সেলিম, তুই কেন এই অসময়ে ? ঢাকায় সবাই কেমন আছে ?”
- আম্মা, বড় আপার শরীরটা একটু খারাপ । আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে ।
মা কেন যেন ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “কী হয়েছে আমার রতনের?”
- আপার টিউমার হয়েছে, অপারেশন লাগবে । আপা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন ।

মা বাড়ির সবার কাছে বিদায় নিয়ে সেই দুপুরেই বাড়ি ছাড়লেন । সেই মা’র গ্রামের বাড়ি একেবারে ছেড়ে আসা । একাত্তরের মার্চে অপরিকল্পিত ঢাকা ছেড়ে গ্রামে এসেছিলেন । এবার অপরিকল্পিত ফিরতি পথ ধরলেন ।

তারপর চলল আট মাসের এক অসম যুদ্ধ । ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের এগার নাম্বার কেবিন হল অস্থায়ী নিবাস । হাসপাতালের বাতাসে সেভলনের গন্ধ, থমকে থাকা দিন রাত্রি । করিডোরে পায়চারী করা নুয়ে পরা মুখগুলো পরাজিত ।

সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে । আমেরিকা থেকে মিয়াভাই চলে এলেন । বড় আপার জন্য আনা শাড়িটা বড় আপা আয়া, নার্স, ডাক্তার সবাইকে দেখালেন, “আমার ছোট ভাই আমেরিকায় পিএইচডি করছে । আমাকে দেখার জন্য সব ফেলে চলে এসেছে ।” মিয়াভাই আসার ঠিক পাঁচ দিন পরে জুলাইয়ের এক শেষ রাতে বড় আপা চলে গেলেন ।

সেই প্রথম মৃত্যু খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে গেল ।

আমার বড় ভাই-বোনেরা দেখেছে মা’র কড়া শাসন । আমি দেখেছি মা’র শুধু আগলে রাখা মমতা । মা ক্যান্সারের কাছে উনত্রিশ বছরের সন্তানকে হারিয়েছেন । মা কি তাই এমন আগলে রাখতেন ? মাও কি খুব ভয় পেতেন ?

(...)
____
সূত্র: কবিতাটির রচয়িতা মদনমোহন তর্কালংকার ।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

অনেকদিন পর লিখলেন।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

ঠিক বলেছেন । ধন্যবাদ ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

সত্যপীর এর ছবি

অনেকদিন পর লিখলেন।

..................................................................
#Banshibir.

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

একদম ঠিক কথা । ধন্যবাদ ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অনেক দিন পরে আপনার লেখা পড়তে পেয়ে খুব ভালো লাগলো। আপনি সুস্থ আছেন তো?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

ধন্যবাদ পান্ডব । ভালো আছি । আশা করি আপনিও কুশলে আছেন ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

এক লহমা এর ছবি

৬ বছর পর ফিরে এলে গো জোহরা দিদি। খুব ভালো লাগছে। ভালো আছ ত? তোমার মন-কাড়া পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ দাদা । আশা করি ভালো আছো ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বহুদিন পর মায়াবী লেখা! পরের পর্বের জন্য পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অতিথি লেখক এর ছবি

মানুষ সম্ভবত পোষা প্রানী, সুখ পুষে, দুঃখ পুষে, স্মৃতি পুষে.. পুষতে পুষতে এক সময় স্মৃতিতেই বেঁচে থাকে৷ ভালো লাগলো স্মৃতি কথা।

মন মাঝি এর ছবি

আমাদের স্মৃতির মানুষগুলি কি কোনোদিন আসলে ছিল? কোনো মানুশই কি কোনোদিন ছিল আসলে?? আমরাই কি আছি???

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

মন্তব্যটা ঠিক মত আসেনি। এটা ঠিক উপরের "অতিথি লেখক"-এর মন্তব্যের প্রতিমন্তব্য! হাসি

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

জীবনের সঙ্গে ট্রেন জার্নির বেশ মিল । স্টেশন থেকে স্টেশনে ছুটছে ট্রেন, কেউ উঠছে কেউ নামছে । কেউ কাছে আসছে, কেউ যাচ্ছে দূরে । জীবনভর সেই জার্নিতে শুধুই হারিয়ে যাওয়ার ভয়, হারিয়ে ফেলার ভয়...

আমার তো মনে হয় আমরা গোড়া থেকেই হারিয়ে আছি! আঁধার রাতে মরুভূমির মধ্য দিয়ে অজানার উদ্দেশে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা ট্রেন জোনাকির সারির মত আলোকিত সাময়িক কেবিন থেকে প্রিয়জনদের কোন জগৎ-বিচ্ছিন্ন নির্জন ভুতুড়ে স্টেশনে নামিয়ে দেয় জানি না। চলতে চলতে একসময় মনে হতে থাকে ঐ প্রিয়মানুষগুলি কি সত্যিই একসময় আমার সহযাত্রী ছিল? নাকি সবটাই কল্পণা? আর কখনও কি তাঁদের দেখা পাব না? অন্ধ ট্রেন একসময় আমাকেও এমনই কোন এক ভুতুড়ে নির্জন স্টেশনে নামিয়ে দেবে। এটা কি আদৌ কোনো স্টেশন? নাকি অস্তিত্ত্বের ক্ষণিক মায়া থেকে চিরমুক্তির চূড়ান্ত কৃষ্ণগহ্বর? এখানে গেলে কি আমার এত সাধে লালিত ঐ হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষদের স্মৃতিটুকুও মনে থাকবে, দেখা হওয়া বাদই দিলাম? নিজেকেই কি মনে থাকবে? কিম্বা ঐ জীবনরূপী ট্রেনটাকেই? ঐ প্রিয় মানুষগুলি কি আসলেই ছিল? ঐ ট্রেনটাই কি ছিল আসলে? এমনকি আমিই কি ছিলাম? প্রিয়মানুষ-ট্রেন-আমি কেউ কি ছিল আদতেই???

****************************************

নীলকমলিনী এর ছবি

অনেকদিন পর সচলে ঢুকে তোমার লেখা পড়লাম। কেমন আছো তুমি?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।